ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা আবারো বিশ্ব দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে। রোববার সকাল ৯টায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ছিল ৩০৮। ৩০১ থেকে ৪০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। পাকিস্তানের লাহোর ও ভারতের দিল্লী যথাক্রমে ২৭৮ ও ২৫৭ একিউআই স্কোর নিয়ে তালিকার পরবর্তী দুইটি স্থান দখল করেছে। ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘খারাপ’ বলা হয়। বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি বৈশিষ্টের ওপর ভিত্তি করে- বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)। দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণে ভুগছে ঢাকা। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে- ঢাকার বায়ু দূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোনো ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়।
বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আমরা দেখছি, ‘ঢাকার বাতাসে ভয়াবহ বিপদ!’ আমরা ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণ করছি! খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ, পানিতে বিষ, মাছ-ফল-সব্জিতে বিষ, চলাফেরায় ঝুঁকি। এরকম কত কিছুর ঝুঁকি নিয়েই আমরা চলছি! এটি সত্যিই দুঃখজনক। হতাশার যেন শেষ নেই। সব যায়গায় সমস্যা! এসব দেখারও যেন কেউ নেই! অনুধাবন বা অনুভাবন করারও যেন কেউ নেই!
বার বার কেন শীর্ষে ঢাকা: ঢাকা কেন বারবার দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রথম হবে? সিটি কর্পোরেশন, সড়ক পরিবহন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যদি পরিবেশ দূষণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তাদের কাজটা কী? শুধু বসে বসে বেতন নেওয়া? সরকারি প্রায় সব অফিসের কর্তারা বসে বসে বেতন নিতে আগ্রহী। কাজ করতে আগ্রহী নয়। বায়ুদূষণ রোধে অনেকগুলো সংস্থা নানা ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত। বায়ুদূষণের কারণগুলো দূর করার বিষয়ে তাদের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কালো ধোঁয়াসহ ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসে ছড়ানো ফিটনেসহীন মোটরযানগুলোর চলাচল বন্ধ করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার। ঢাকার চারপাশের ইটভাটাগুলোর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি ও অন্যান্য নির্মাণকাজের সময় ধুলা ওড়ানো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাধ্য করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাহলে এসব কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ আছে কী? ধুলা-বালির কারণে বৃদ্ধ, শিশুসহ নিরিহ জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী দেশের কতিপয় ধান্দাবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সেবাদানকারী নামে খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো। গবেষণায় যখন উঠে আসে, ‘বায়ুদূষণে এক নম্বরে ঢাকা’ তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে; সিটি কর্পোরেশন কি আছে, নাকি বিলুপ্ত হয়েছে? থাকলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও দুই সিটির এই কি সফলতা? রাজধানীর সড়কগুলোতে ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন সকালে দুই সিটি করপোরেশন থেকে পানি ছিটানোর নিয়ম রয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় সিটি কর্পোরেশনের কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই। এর প্রতিকার কার কাছে আছে? কে দেবে সমাধান?
বাতাসে অতিমাত্রায় ধুলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শহরের গাছগাছালিও। গাছের পাতায় জমছে ধুলার আস্তরণ। এর ফলে গাছের খাদ্য ও অক্সিজেন তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শুধু তাই নয়, পাতার পত্ররন্ধ্র ও সূর্যের আলোর মাঝখানে ধূলিকণার আস্তর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। ফলে কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহণ করতেও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে গাছ। সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় শুধু খাদ্য তৈরিই করে না, অক্সিজেনও রিলিজ করে। মানুষ, জীবজন্তু অক্সিজেনের মাধ্যমে বেঁচে থাকে, আর সেই অক্সিজেনের উৎসই হচ্ছে উদ্ভিদ। ধূলিকণার কারণে সালোকসংশ্লেষণ যেহেতু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সুতরাং তা আমাদের পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করছে। বাতাসে মিশ্রিত সালফার, সিসা, দস্তা ইত্যাদি ধাতুকণা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর; বিশেষত বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক পরিবেশদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বছরে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার দুই তৃতীয়াংশই বায়ুদূষণের ফলে। বায়ুদূষণের কারণে হৃদ্রোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যান্সার হয়। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব প্রকট হয়ে থাকে। বায়ুদূষণ নিয়ে উদাসীন থাকার বিলাসিতায় বেশি দিন গা ভাসানোর সুযোগ হয়তো আমারা পাবো না। কারণ, ততদিন পর্যন্ত আমাদের শ্বাসযন্ত্র আর ক্যানসার প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর সে ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক সতর্কবার্তাও রয়েছে। সর্বব্যাপী বায়ুদূষণে মানুষের আয়ু কমছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে মানুষের আয়ু গড়ে প্রায় ৩ বছর কমছে। একই কারণে প্রতিবছর ৮৮ লাখ (৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন) অকালমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গবেষকরা বলেন, তামাক সেবনের চেয়েও বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটা বড় ঝুঁকির বিষয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অকালমৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে ম্যালেরিয়ার চেয়ে বায়ুদূষণে বছরে ১৯ গুণ বেশি মৃত্যু হয়। এইচআইভি/ এইডসের চেয়ে বায়ুদূষণে হয় ৯ গুণ বেশি মৃত্যু। আর অ্যালকোহলের চেয়ে বায়ুদূষণে হয় ৩ গুণ বেশি মৃত্যু।
কর্তৃপক্ষ চাইলে এই সমস্যার ৮০ ভাগ রোধ করতে পারে আইনি কঠোরতার মাধ্যমে। রাস্তাঘাট বাড়ীঘর নির্মাণে যার দ্বারা ধুলির উৎপত্তি, তাকে দিয়েই সাথে সাথে সেটা অপসারণ করাতে হবে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বালির ব্যবহার সিমেন্টের মত বস্তায় ভরে নির্মানস্থলে আনা-নেওয়া ছাড়াও রাস্তার পাশে ঢেলে রাখা যাবেনা। একদিকে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ট্রাকে বালু পরিবহনে পুরো রাস্তায় বালু ছিটিয়ে রাখা, অন্যদিকে রাস্তায় বালু স্তুপ করে রেখে কাজ করা সভ্য পৃথিবীর কোথাও নেই। সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িগুলো রাস্তায় ময়লা ফেলতে ফেলতে যায়। আজ ওয়াসা তো কাল ডেসা, কাল ডেসা তো পরশু তিতাস, এরপরদিন সিটি কর্পোরেশন, তারপর দিন বিদ্যুৎ কিংবা টিঅ্যান্ডটির সমন্বয়হীন কাটাকাটি চলছেতো চলছেই। এ খবর কে না জানে? কে আছে দেখার? কার কাছে বিচার? এই খোঁড়াখুঁড়ি যদি সমন্বয় করে করা হতো, তাহলে জনভোগান্তি যেমন কমত, বায়ুদূষণও কমিয়ে আনা যেত। এই সমন্বয়হীনতার প্রভাব নাগরিক জীবনকে কীভাবে বিষিয়ে তুলছে, সে খবর রাখার দায় যেন কারো নেই। সরকারি হিসাবে যেসব খালের কথা উল্লেখ আছে, সেগুলোর ছিটেফোঁটাও বাস্তবে পাওয়া যায় না। এর ফলে মানুষের দুর্দশা আর ভোগান্তি অন্তহীন। বর্ষায় রাস্তায় মানুষকে সাঁতরিয়ে নোংরা পানিতে, আর শুকনা মৌসুমে ধুলার বন্যায় চলতে হয়। এই হলো আমাদের নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা। অথচ বায়ুদূষণ প্রতিরোধযোগ্য। পৃথিবীর যেসব শহর বায়ুদূষণে ধুঁকছে, বরাবরই সেগুলোর তালিকার একদম শীর্ষে অথবা শীর্ষের কাছাকাছি জায়গা হয় আমাদের ঢাকার। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের যে পাঁচ দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম।