আবহমান গ্রামবাংলায় রাতের কুয়াচ্ছন্ন আকাশ আর ঠান্ডার আভাস নিয়ে এসেছে প্রকৃতিতে শীতের বার্তা। শীতের সকাল মানেই যেন অদ্ভুত এক আলসেমী। আরাম দায়ক বিছানা বা লেপ কাথার উষ্ণতা কিছুতেই ছাড়তে চায় না মন। তবুও কুয়াশার চাদর সরিয়ে উকি দেয় মিষ্টি রসের লোভ। এক গ্লাস টাটকা রসে জমে ওঠে যেন শীতের আমেজ। শীতের হীম জড়ানো ভোরে খেজুরের রস আহরণ ও গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলার গাছিরা। গুড় তৈরিতে গাছিদের ব্যস্ততায় গল্পেরও রঙ বদলায়। কুয়াশা মাখা ভোরে রস আহরণে নিয়মিত ছুটে চলেন গাছিরা। আবহমান গ্রামবাংলায় শীতের সকালে সূর্য্য মিটমিট করে আলো ছড়ানোর আগেই রস আহরণ প্রক্রিয়া ও রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করার দৃশ্য দেখতে বেরিয়ে পড়ি। সালথা উপজেলার যদুনন্দী গ্রামে সড়কের দুইপাশে দুপুর দুই টার দিকে বয়স্ক ও অর্ধবয়স্ক গাছিরা খেজুর গাছকাটা ছ্যান নিয়ে ও কোমরের সাথে গাছে দড়ি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাঁছা ছোলার কাজ শুরু করতে দেখা যায়। গাছ চাছা শেষে বাঁশের নলি লাগিয়ে রস আহরণের জন্য মাটির হাড়ি পাতা হয়। পরের দিন কুয়াশার ভোরে গাছ থেকে খেজুরের রস আহরণ শেষে হাঁড়িতে সংগৃহীত রস নিয়ে বড় চুলার কাছে ছুটে যান গাছিরা। এরপর টিনের বড় পাত্রে রস ঢেলে জ্বাল দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে এসব রস শুকিয়ে আড়াই থেকে তিন ঘন্টার ব্যবধানে জ্বালানোর পর শুরু হয় গুড় তৈরির প্রক্রিয়া। জানা যায়, শীত মৌসুম এলেই এ উজেলায় সর্বত্র শীত উদযাপনের নতুন আয়োজন শুরু হয়। খেজুরের রস আহরণ ও গুড় তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এ এলাকার গাছিরা। শীতের দিন মানেই খেজুর রস ও পাটালী গুড়ের মৌ-মৌ গন্ধ। খেজুর গুড় বাঙালির সংস্কৃতির একটা অঙ্গ। খেজুরের গুড় ছাড়া আমাদের শীতকালীন উৎসব ভাবাই যায় না। খেজুরের গুড় দিয়ে পিঠা-পায়েসসহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়। এই শীতের দিনে মেয়ে – জামাইদের শীতের পিঠা খাওয়ানো হয় এই খেজুরের রস ও গুড় নিয়ে। খেজুরের রসে জামাই আদরের প্রথা এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। খেজুর গাছের তুলনায় গাছির অভাব রয়েছে। এছাড়াও বেশী লাভের আশায় অসাধু গুড় ব্যবসায়ী কৃত্রিম গুড় তৈরী করে ক্রেতা সাধারনের সাথে প্রতারনা করে চলেছে। নিজেরা লাভবান হন প্রতারনা আর ভেজাল গুঁড়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলান ক্রেতাদের। ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনের নজরদারি করা উচিত বলে সাধারণ মানুষ দাবি করেছেন। যদুনন্দী এলাকার গাছি ইয়ার আলী ও গাছি আল আমিন জানান, গাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু হয়েছে। রস থেকে গুড় তৈরির পর্ব শুরু হয়ে শীতের চার মাস খেজুরের রস পাওয়া যাবে। সপ্তাহখানেক আগে থেকে বাজারগুলোতে উঠতে শুরু করেছে সুস্বাদু খেজুরের পাটালি ও গুড়। তাই অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুরের গাছের কদর এখন অনেক বেশি থাকলেও গাছির সংখ্যা কম। নির্ভেজাল গুড় প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা বিক্রি করলে পরিশ্রমের মূল্য পাওয়া যায়। আবার অনেকেই টাটকা রস পাওয়ার জন্য সকালে হাড়ি ভর্তি রস কিনে নিয়ে যায়। রস বিক্রি করার পর অবশিষ্ট যে রস থাকে তা দিয়ে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা হয়। সপ্তাহে সোম ও শুক্রবার এই এলাকার গাছিরা গুড় তৈরি করেন। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা গুড়ের সাথে চিনি মিশিয়ে বাজারে কম দামে গুড় বিক্রি করায় আমাদের নির্ভেজাল গুড় কেউ নিতে চায় না। ভেজাল গুড় বিক্রি বন্ধ হলে গাছিরা লাভবান হতো। সালথা উপজেলা কৃষি অফিসার জীবাংত্ত দাস জানান, উপজেলায় অনেক খেজুর গাছ আছে। এর মধ্যে যদুনন্দী, উজিরপুর-সাধুহাটি, খারদিয়া, আটঘর এলাকাতে বেশি সংখ্যক গাছ রয়েছে। অনেকে আগাম গাছ প্রস্তুত করায় বাজারে কিছু গুড়ও পাওয়া যাচ্ছে। গাছিরা খেজুর রস আহরণ করে ঝোলা গুড় ও পাটালি গুড় তৈরি করে নিকটস্থ বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হোন। বর্তমানে খেজুর গুড়ের চাহিদা বেশী যার কারনে গাছিরা এদিকে যেমন লাভবান হচ্ছে ঠিক তেমনি আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হচ্ছে।