আফ্রিকান একটা প্রবাদ আছে, দুই হাতির মারামারিতে, উলখাগড়ার প্রাণান্ত। কিন্তু যখন একটি বড় ভালুক একটি ছোট প্রাণীকে আক্রমণ করে তখন আসলে কী ঘটে? এসব যদিও লোকের মুখে মুখে চলে আসা কথা। তবুও ২০২৩ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ক্ষমতার মধ্যভাগে কী থাকছে। রক্তাক্ত ইউক্রেনকে নিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের অনেক ভূ-রাজনৈতিক হিসাব পরিবর্তন হচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পুতিনের ভূ-রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের হিসাব-নিকাশ।
ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন হেরে গেলে, কিছু দেশ যারা রাশিয়াকে ভয় পায়, যেমন বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো (উত্তর ইউরোপে বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত রাষ্ট্রসমূহকে বুঝায়। এসব দেশ হলো এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া) কম ভয় পাওয়া শুরু করবে। অন্যরাও উদ্বিগ্ন হবে একটি পরাজিত রাষ্ট্রকে নিয়ে।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন কাজাখস্তানকে সরাসরি হুমকি দেননি, যেখানে ইউক্রেনের মতো রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে দেশটির এবং রাশান ভাষার সংখ্যালঘুরাও রয়েছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাশিয়ান বুদ্ধিজীবীরা জমি দখল করে এটি ভেঙে ফেলার অনুরোধ করেন জাতিগতভাবে রাশিয়ানদের কাল্পনিক নিপীড়ন থেকে ‘রক্ষা’ করার জন্য।
কাজাখস্তান সম্পর্কে তাদের ‘মিথ্যা’ ধারণার সঙ্গে ইউক্রেন সম্পর্কে তারা যা বলে তার সঙ্গে একটি ভীতিকর মিল রয়েছে। এটির রাশিয়ান সীমান্তের কাছে বায়ো ওয়ার ফেয়ার ল্যাব রয়েছে। দেশটি স্কুলে রাশিয়ান-ভাষা শিক্ষা নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনাও করছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে কাজাখদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণও থাকবে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আভাস দেয়, মস্কো থেকে শাসিত কোনো দেশই নিরাপদ নয়। সেকারণে যারা ন্যাটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে তারা তা করবে। যেমন জর্জিয়া ও মলদোভা আগ্রহী ন্যাটোতে যোগ দিতে। কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানের মতো যারা ন্যাটো থেকে সাহায্য আশা করতে পারে না তারা চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠুক, এমনটা চাইবে। যদি তাদের ভূখ-ে চীনা রেলওয়ে এবং কারখানা থাকে, তবে তারা ধরে নেয়, রাশিয়ার তাদের ওপর আক্রমণ করার সম্ভাবনা কম। ২০২৩ সালে রাশিয়ার কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা থাকবে বিশেষ করে ইরানের। কারণ একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একজন বন্ধু প্রয়োজন বলে মনে করে তারা।
রাশিয়ার সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল শাসনব্যবস্থা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবে। বেলারুশের স্বৈরাচারী শাসক, আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, পুতিনের সমর্থনের জন্যই মূলত ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন। বিনিময়ে, তিনি বেলারুশিয়ান অঞ্চলটিকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রাশিয়ার আক্রমণের জন্য একটি লঞ্চপ্যাড হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন, যেটি ব্যর্থ হয়। বেলারুশিয়ানদের কাছে অত্যন্ত অজনপ্রিয় লুকাশেয্কো এবং নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ থাকায় প্রেসিডেন্টের কার্যক্রমকে অবজ্ঞা করে তারা। তবে পুতিন তাকে চাপ দেবেন বলে মনে হচ্ছে।
আফ্রিকায়, ওয়াগনার, পুতিন ঘনিষ্ঠের পরিচালিত একটি ‘ভাড়াটে’ দল, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও মালিতে স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন করে এবং লিবিয়ায় একজন যুদ্ধবাজকে সমর্থন করে। কিন্তু ওয়াগনারের কিছু ঠিকারদারকে ইউক্রেনে লড়াই করার জন্য ডাকা হয়েছে। যদি এর আফ্রিকান কার্যক্রম কখনও রাশিয়ান রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সমর্থন হারায় তবে তারা তাদের ক্লায়েন্টদের ক্ষমতায় রাখতে লড়াই করবে বলে মনে হচ্ছে।
যতক্ষণ যুদ্ধ জ্বালানির বাজারকে অস্থির রাখবে ততক্ষণ জ্বালানি উৎপাদনকারীরা তাদের কূটনৈতিক প্রভাব বজায় রাখবে। তেল উৎপাদনকারী সৌদি আরব তার মানবাধিকার রেকর্ড উন্নত করতে বা অর্থনীতিতে বৈচিত্র্যতা আনতে সামান্য বাস্তব চাপ অনুভব করবে। রাশিয়ান গ্যাসের বিকল্প সরবরাহকারীরাও উন্নতি লাভ করবে। ইউরোপ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় রপ্তানিকারক দেশ কাতারের দিকে ঝুঁকছে। ইসলামপন্থিদের সমর্থন নিয়ে একসময় কাতারের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত মিশরও, এখন আর্থিক সহায়তার আশায় কোলাকুলি করছে।
বাজারে উচ্চ খাদ্যমূল্য ও জ্বালানি মূল্যের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঢেউ অব্যাহত থাকবে। অনেক দেশে বিক্ষোভ ও দাঙ্গা দেখা দিয়েছে এরই মধ্যে। অর্থনৈতিক গোলযোগের জেরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকেও উৎখাত করা হয় সম্প্রতি। ২০২৩ সালে খাবারের দাম কিছুটা কমলেও, পাকিস্তান ও তিউনিসিয়ার মতো জায়গায় অস্থিরতা বাড়বে। নির্বাচনে জালিয়াতিসহ বিভিন্ন কারণে যেসব দেশের অর্থনীতিতে গোলযোগ তৈরি হয়েছে, ২০২৩ সমস্যা আরও প্রকট হবে, যেমন, নাইজেরিয়া ও তুরস্কে?
কূটনৈতিকভাবে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবেই হোক না কেন তার সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। পুতিন হেরে গেলে ও রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়লে, সিরিয়া এবং দক্ষিণ ককেশাসের মতো তুরস্কেও ক্ষমতার শূন্যতা দেখা দিতে পারে। যদিও আর্মেনিয়ার প্রতি রাশিয়ান সমর্থন দোলা দেয়। তবে এরদোয়ান আজারবাইজানের প্রতি তার সমর্থন জোরদার করবেন, যেটি ভূখ- নিয়ে আর্মেনিয়ার সঙ্গে লড়াই করছে।
যদি ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকে তবে এরদোয়ান উভয় পক্ষের সঙ্গে খেলা চালিয়ে যাবেন। রাশিয়ান অর্থ ও পর্যটকদের স্বাগত জানানোর জন্য তিনি মস্কোর কাছ থেকে সস্তা গ্যাসের মতো পুরস্কার আশা করবেন। তিনি ইউক্রেনের কাছে আরও অস্ত্র বিক্রি করবেন এবং কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ প্রবেশকে অস্বীকার করার জন্য পশ্চিমাদের কাছ থেকে ক্রেডিট দাবি করবেন। এরদোয়ান জুনে একটি নির্বাচনে হেরে গেলে, তার উত্তরসূরি সম্ভবত বৈদেশিক নীতিতে একই পদ্ধতি অবলম্বন করবেন।
সামগ্রিকভাবে, ইউক্রেনে পুতিনের অপমান স্বৈরাচারীদের জয়ের যুদ্ধ শুরু করার বিষয়ে সতর্ক করে তুলবে। ইউক্রেনের সমর্থকদের জন্য তাদের সমর্থন দ্বিগুণ করা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো দেশের প্রতি আগ্রাসন উচিত নয় কিংবা আগ্রাসনে ইন্ধন যোগানোও উচিত নয়। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন হেরে গেলে বিশ্ব দীর্ঘমেয়াদে আরও শান্তিপূর্ণ হবে। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট