আপনি যে ডিভাইসে এই প্রতিবেদনটি পড়ছেন তা সম্ভব হয়েছে নিকোলা টেসলার কিছু উদ্ভাবনের কারণে। ‘টেসলাকে আমি শুধু বিদ্যুতের কিংবা বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের জনক হিসেবেই দেখি না, তার ধ্যান-ধারণা তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল,’ বলেছেন ঐতিহাসিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা মিশায়েল ক্রজে।
‘তিনি ছিলেন স্বপ্নচারী। মানবজাতির বিবর্তনে তিনি তার অবদান রেখে গেছেন।’
১৮৯০-এর দশকে পৃথিবীর বেশিরভাগ এলাকা যখন অন্ধকারে ডুবে ছিল, নিকোলা টেসলা তখন জ্বলন্ত টিউব হাতে নিয়ে নিউ ইয়র্কে কলাম্বিয়া কলেজের মঞ্চে উঠেছিলেন তার নতুন-উদ্ভাবিত একটি ট্রান্সফরমার প্রদর্শনের জন্য।
এটি ছিল ‘অসিলেটিং ট্রান্সফরমার’ – যাতে ক্রমাগত বিপরীতমুখী দোলায়মান বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। ‘তখনও পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল ভবিষ্যতের বিষয়। এটি দেখতে হলে বেশিরভাগ লোকজনকে যেখানে বিদ্যুৎ প্রদর্শন করা হতো সেখানে যেতে হতো,’ ঐতিহাসিক ইওয়ান রিস মোরাস তার ‘নিকোলা টেসলা এবং বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ’ গ্রন্থে এই মন্তব্য করেছেন। কিন্তু দ্রুতই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো। নিকোলা টেসলার জন্ম ১৮৫৬ সালে, অস্ট্রিয়ান হাপসবুর্গ সাম্রাজ্যে। তিনি যে শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন সেই স্মিলিয়ান এখন ক্রোয়েশিয়ার অংশ। যদিও তার পরিবার ছিল সার্বিয়ান। তরুণ বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
নিকোলা টেসলা ১৮৮৪ সালে নিউ ইয়র্কে গিয়ে পৌঁছানোর পর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী এবং ব্যবসায়ী টমাস এডিসনের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। ‘তিনি এসেছিলেন প্রাচীন এক বিশ্ব থেকে, কিন্তু পরে তিনি আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান এক চরিত্রে পরিণত হন,’ বলেন মি. ক্রজে। নিকোলা টেসলার জীবনী নিয়ে কাজ করেছেন এরকম আরেকজন ঐতিহাসিক ইনেজ হুইটাকার হান্ট বলেছেন – টেসলা যখন আমেরিকার মাটিতে পা ফেলেন তখন ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল এই ইঞ্জিনিয়ারের হাতে ছিল অল্প কিছু অর্থ। তার সঙ্গে ছিল উড়ন্ত এক যন্ত্র (বিমান) নির্মাণের কিছু হিসাব নিকাশও।
কিন্তু উড়ন্ত এই মেশিনের কারণে টেসলা বিখ্যাত হয়ে ওঠেন নি। এর পরের কয়েক বছর তিনি অল্টারনেটিং কারেন্ট মোটর তৈরির জন্য কাজ করেছেন।
বিশ্বে তখন আরও বেশি বিদ্যুতের প্রয়োজন ছিল এবং সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাজ চলছিল। সেসময় সহজে ও অল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেই বিদ্যুৎ পরিবহন এবং বাতি জ্বালানোর উপায় খুঁজে বের করার জন্য এক প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল।
‘বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারে তখন দু’ধরনের ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল,’ বলেন মি. মোরাস।
এই লড়াই ছিল আমেরিকান ব্যবসায়ী ও প্রকৌশলী জর্জ ওয়েস্টিংহাউজ এবং নিকোলা টেসলার বস টমাস এডিসনের মধ্যে। তাদের যুদ্ধের বিষয়: অল্টারনেটিং কারেন্ট (এসি) না কি ডাইরেক্ট কারেন্ট (ডিসি) কোন পদ্ধতিতে বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন বা পরিবহন সম্পন্ন হবে তা প্রতিষ্ঠা করা।
টমাস এডিসনের কোম্পানি ডাইরেক্ট কারেন্টের পেছনে বিনিয়োগ করছিল। এই পদ্ধতিতে একই ভোল্টেজের বিদ্যুৎ স্বল্প দূরত্বে শুধুমাত্র একদিকে প্রবাহিত হয়।
কিন্তু অল্টারনেটিং কারেন্ট পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ নানা দিকে প্রবাহিত হতে পারে, পাড়ি দিতে পারে লম্বা পথ এবং একই সঙ্গে বিদ্যুতের ভোল্টেজ বাড়ানো এবং কমানোও যেতে পারে।
এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ যেহেতু অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে সেকারণে এর সাহায্যে অনেক স্থানে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ‘এটা অনেকটা জেট বিমানের সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ির তুলনা করার মতো,’ বলেন টেসলার জীবনীকার মার্ক সাইফার।
টেসলা যখন নিউ ইয়র্কে পৌঁছান তখন ‘জেট বিমান’ নির্মাণের এক পরিকল্পনা তার পকেটে ছিল। ইউরোপে কাজ করার সময় তিনি অল্টারনেটিং কারেন্ট বা এসি পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন।
১৮৮৩ সালে তিনি প্রথম তার প্রথম ‘ইন্ডাকশন মোটর’ নির্মাণ করেন। কিন্তু ব্যবসায়ী এডিসন যেহেতু ডাইরেক্ট কারেন্ট বা ডিসি পদ্ধতির ওপর জোর দিচ্ছিলেন, সেহেতু তারা দু’জন আলাদা হয়ে যান।
এর পরে প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়েস্টিংহাউজ খুব শীঘ্রই টেসলার উদ্ভাবিত অল্টারনেটিং কারেন্ট ট্রান্সফরমার এবং মোটরের পেটেন্ট রাইট বা মালিকানা স্বত্ব কিনে নেন।
টেসলার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে স্বল্প খরচে অনেক দূর পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রেরণ করা যায় এবং আজকের দিনেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘আমরা এখনও অল্টারনেটিং কারেন্ট বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি, এবং যে প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পরিবহন করা হচ্ছে তা টেসলার ধারণার ওপর ভিত্তি করেই করা হচ্ছে,’ বলেন বেলগ্রেডে নিকোলা টেসলা জাদুঘরের একজন পরিচালক ইভানা জরিচ।
যে পদ্ধতিতে এখনও বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে, এবং সেই বিদ্যুৎ পরিবহন ও সরবরাহ করা হচ্ছে, তা মূলত নিকোলা টেসলার উদ্ভাবিত পদ্ধতিতেই করা হচ্ছে। এছাড়াও আজকের দিনে যেসব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বা ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোও টেসলার অন্যান্য উদ্ভাবনের ওপর নির্ভরশীল। ‘ইন্ডাকশন মোটর একটি দারুণ উদ্ভাবন। বর্তমানেও কলকারখানায় এবং বাসাবাড়ির বহু জিনিসপত্রে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি ইলেকট্রিক গাড়িতেও,’ বলেন জরিচ।
তিনি টেসলা কয়েল উদ্ভাবন করেছেন ১৮৯১ সালে। এই ডিভাইস এমনভাবে বিদ্যুৎ নির্গত করে যা উড়তে পারে। এর ফলে তার ছাড়াই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব। রেডিও এবং টেলিভিশন সেট ছাড়াও আরো কিছু বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে আজকের দিনেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
দু’বছর পর টেসলা এবং ওয়েস্টিংহাউজ শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ডস কলাম্বিয়ান এক্সপোজিশনে আলোকসজ্জার দায়িত্ব পান। ইউরোপের আমেরিকা আবিষ্কারের ৪০০তম বার্ষিকী উপলক্ষে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছিল।
এই মেলায় নিকোলা টেসলা একজন নায়কে পরিণত হন। ‘লোকজন যখন এই উদ্ভাবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারলো, তখন টেসলাকে নায়াগ্রা ফলসে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দায?িত্ব দেওয়া হলো,’ বলেন জরিচ।
এটি বিশ্বের প্রথম জলবিদ্যুৎ পাওয়ার প্ল্যান্ট। এই কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে যে ১৩টি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তার ন’টিরই মালিক নিকোলা টেসলা।
‘লোকজন জানতো কে এই মি. টেসলা এবং সেখানে তার কী ভূমিকা ছিল,’ বলেন মোরাস।
এর পরে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিকোলা টেসলা তার ল্যাবরেটরি নির্মাণ করেন। এই পরীক্ষাগারে তিনি ওয়্যারলেস বা তারবিহীন যোগাযোগ এবং তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহনের বিষয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন।
লোকজনের জন্য তিনি তার ল্যাবরেটরির দরজা খুলে দিয়েছিলেন যাতে করে তারা তার কুশলী জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। ‘তিনি তারবিহীন এক বিশ্ব তৈরির ব্যাপারে তার অনন্য স্বপ্ন বিক্রি করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি চাইছিলেন বিদ্যুৎকে মুক্ত করে দিতে। একই সঙ্গে তিনি এটাও বোঝাতে চাইছিলেন তিনি হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যে ভবিষ্যতে এই কাজটি সম্ভব করে তুলতে পারেন।’
তারবিহীন ভবিষ্যৎ
সারা বিশ্ব যখন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বার্তা প্রেরণের জন্য তারের ওপর নির্ভরশীল ছিল, নিকোলা টেসলা তখন তার ছাড়া কিভাবে বার্তা প্রেরণ করা যায় তা নিয়ে পরীক্ষা চালাতে শুরু করেন।
কিন্তু তার এসব নতুন ধরনের পরীক্ষা চালানোর জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন ছিল। ১৮৯০-এর দশকে এই অর্থ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন আমেরিকান অর্থদাতা জে. পি. মরগ্যানের কাছ থেকে।
এর পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লং আইল্যান্ডে তারবিহীন বিশ্ব সম্প্রচার টাওয়ার নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তার লক্ষ্য ছিল তারবিহীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা বিশ্বে যোগাযোগের একটি উপায় খুঁজে বের করা। এই পদ্ধতিতে ভিডিও এবং অডিও বার্তা আদান প্রদান করা সম্ভব।
এর ফলে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো স্থান থেকে তথ্য পেতে পারবেন। কিন্তু তখন মর?গ্যান তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন।
‘দুর্ভাগ্য যে এর ফলে তার যে একটা বড় স্বপ্ন ছিল-লোকজনের জন্য বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি তৈরি করা – সেটা আর সম্ভব হলো না। কারণ তিনি তখনও সেটা করে উঠতে পারেন নি অথবা সেই প্রযুক্তি তখনও ছিল না, বলেন ক্রজে।
এর পরে টেসলা বিভিন্ন প্রকল্পে তার কাজ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু অর্থের অভাবে তার সেসব চিন্তাভাবনা শুধু কাগজ-কলমের মধ্যেই সীমিত থেকে যায়। তিনি বুঝতে পারেন নি যে বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল এমন এক প্রক্রিয়া যাতে বহু মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
‘টেসলা তখন বড় ভুলটি করলেন। তিনি ভেবেছিলেন তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন। সহযোগিতার ভিত্তিতে অন্য লোকজনকে সাথে নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী ছিলেন না,’ বলেন মোরাস। তিনি পাগলাটে এক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
অন্যান্য গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার যেসব ধারণা ছিল সেগুলোও তখন সমালোচিত হতে থাকে।
টেসলার মৃত্যু
নিউ ইয়র্কের একটি হোটেলের কক্ষে ১৯৪৩ সালে নিকোলা টেসলা মৃত্যুবরণ করেন। এই হোটেলে তিনি তার জীবনের শেষ দশকটি কাটিয়েছেন।
‘টেসলার যেসব জিনিসপত্র ছিল সেগুলো ১৯৫১ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে সার্বিয়ার বেলগ্রেডে নিয়ে যাওয়া হয়। তার এক আত্মীয়ের উদ্যোগে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয়,’ বলেন জরিচ।
এর চার বছর পরে বেলগ্রেডে নিকোলা টেসলা জাদুঘর উন্মুক্ত করা হয়। এখনও প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এই জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
এই জাদুঘরে রক্ষিত আছে টেসলার এক লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি জিনিসপত্র যার মধ্যে রয়েছে তার করা কিছু পরিকল্পনা, স্কেচ, নকশা এবং ছবি। টেসলার এই আর্কাইভ অনলাইনেও দেখা যায়। জাদুঘরটিতে যথেষ্ট জায়গা না থাকার কারণে তার ব্যক্তিগত অনেক সামগ্রী কিছু ভল্টেও রাখা হয়েছে। ‘এখন আমরা টেসলার বিছানা, রেফ্রিজারেটর, ওয়ারড্রোব, ১৩টি স্যুট, ৭৫টি টাই এবং ৪০টিরও বেশি গ্লাভস রেখেছি। এছাড়াও তার আরো কিছু সামগ্রী রয়েছে,’ বলেন জরিচ।
‘আমরা আশা করছি আরো জায়গা পাওয়া গেলে এসব জিনিস আমরা প্রদর্শনীতে রাখতে পারবো,’ বলেন তিনি। জাদুঘরটি চালু হওয়ার এক বছর পরে, ১৯৫৬ সালে, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র পরিমাপের একটি একটি এককের নামকরণ করা হয়েছে টেসলার নামানুসারে। সার্বিয়াতে কয়েকটি সড়ক, স্কুল এবং একটি বিমানবন্দরেরও নামকরণ করা হয়েছে তার স্মরণে। সার্বিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া দুটো দেশের মুদ্রায় তার ছবি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের নামকরণও করা হয়েছে এই উদ্ভাবকের নামে। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিকোলা টেসলা কী ভেবেছিলেন? ‘আমার মনে হয় টেসলা হয়তো আজ বলতেন যে মানবজাতি ভবিষ্যতের ব্যাপারে এখন আরাম আয়েশের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে যার ফলে হয়তো সমস্যা তৈরি হতে পারে,’ বলেন জোরিচ। সূত্র: বিবিসি