ব্যাংক কোম্পানি আইন
# ব্যাংকের শেয়ার ১০ শতাংশের বেশি কেনা যাবে না
# পাঁচ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে লাগবে অনুমোদন
# পর্ষদে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজন
# বিনিয়োগ কোষের বাইরে থাকবে বন্ড, ডিবেঞ্চার
# আইনে মালিকদের ইচ্ছার প্রতিফল হয়েছে- আহসান এইচ মনসুর
# শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষতা বাড়বে- শাকিল রিজভী
নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনা ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন চূড়ান্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বন্ড, ডিবেঞ্চার বা ইসলামিক শরিয়াহভিত্তিক নিদর্শনপত্রে বিনিয়োগ ব্যাংকের বিনিয়োগ কোষের (পোর্টফোলিও) বাইরে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সুযোগ দেওয়া হয়েছে এক ব্যক্তিকে টানা ১২ বছর পরিচালক পদে থাকার। তবে পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক আধিপত্য কিছুটা কমিয়ে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজন পরিচালক হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
আগে একটি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ চারজন পরিচালনা পর্ষদে থাকার সুযোগ ছিল। আর পরিচালক হিসেবে টানা ৯ বছর থাকার সুযাগ ছিল। অর্থাৎ, পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক আধিপত্য কিছুটা কমলেও টানা ১২ বছর পদ ধরে রাখার সুযোগ পাচ্ছেন পরিচালকরা। অপরদিকে আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনা বাজারমূল্যে হিসাবের বিধান রাখা হয়েছিল। অবশ্য শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের আগস্টে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনা ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করে একটি নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এখন আইন দিয়েই শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনা ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করে দেওয়া হলো। সম্প্রতি এসব সংশোধনী এনে ‘ব্যাংক-কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩’ এর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। এরই মধ্যে সংশোধন করা বিষয়গুলো দেশে কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংককে পরিপালনের নির্দেশনাও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনা ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করায় এবং বন্ড, ডিবেঞ্চার বা ইসলামিক শরিয়াহভিত্তিক নিদর্শনপত্রে বিনিয়োগ ব্যাংকের বিনিয়োগ কোষের বাইরে রাখাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আগে বাজারমূল্যে বিনিয়োগ গণনা হওয়ার কারণে শেয়ার দাম বাড়লেই ব্যাংকের বিক্রির চাপ বেড়ে যেত। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তো সার্বিক শেয়ারবাজারে। এখন ক্রয়মূল্যে বিনিয়োগ গণনা করায় হঠাৎ বিক্রির চাপ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা কমবে।
এদিকে টানা ১২ বছর পরিচালক পদে থাকার সুযোগ দেওয়াকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যাংক মালিকদের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে। ব্যাংক মালিকরা যে অত্যন্ত শক্তিশালী এর মাধ্যমে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। এটি ব্যাংকখাতের জন্য খুব একটা সুখকর হবে না।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের বিষয়ে সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক ব্যাংক-কোম্পানি এইরূপভাবে উহার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কোষ পুনর্গঠন করিবে যাহাতে ধারণকৃত সকল প্রকার শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, উপ-ধারা(২ক) এ উল্লিখিত নিদর্শনপত্র ব্যতীত অন্যান্য পুঁজিবাজার নিদর্শনপত্রের মোট ক্রয়মূল্য এবং পুঁজিবাজার কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহ, অন্য কোনো কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহে প্রদত্ত ঋণ সুবিধা এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠিত কোনো প্রকার তহবিলে প্রদত্ত চাঁদার পরিমাণ সমষ্টিগতভাবে উহার পরিশোধিত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন্ড আর্নিংস এর মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশের অধিক না হয়।’
আর উপ-ধারা(২ক)-তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক কোম্পানির বন্ড, ডিবেঞ্চার বা ইসলামিক শরিয়াহভিত্তিক নিদর্শনপত্রে বিনিয়াগের সীমা নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সময় সময় নির্দেশনা জারি করবে।
এদিকে আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক কোম্পানি অন্য কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনতে পারবে না। এছাড়া ধারণ করা শেয়ারের ক্রয়মূল্য ওই ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন্ড আর্নিংসের মোট পরিমাণের ৫ শতাংশের বেশি হবে না।
শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনা ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা এবং বন্ড, ডিবেঞ্চার বা ইসলামিক শরিয়াহভিত্তিক নিদর্শনপত্রে বিনিয়োগ ব্যাংকের বিনিয়োগ কোষের বাইরে রাখাকে কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, এটা শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়বে। পাশাপাশি বিনিয়োগ করা শেয়ারের দাম বাড়ার ফলে বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। ফলে হুট করেই ব্যাংকের বিক্রির চাপ আসবে না।
তিনি বলেন, আগে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ গণনা করা হতো বাজারমূল্যে। এতে বিনিয়োগ করা শেয়ারের দাম বেড়ে গেলেই বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে যেত। তখন বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য হুট করেই ব্যাংকের বড় বিক্রির চাপ চলে আসতো। এতে সার্বিক শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তো। এখন ক্রয়মূল্যে বিনিয়োগ গণনা করার কারণে শেয়ার দাম বেড়ে বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে যাবে না এবং হুট করে ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির চাপও আসবে না।
ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কেনা যাবে না
কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাবে না বলে সংশোধিত আইনে একটি বিধান করা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা কোনো পরিবারের সদস্যরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একক বা অন্যের সঙ্গে যৌথভাবে বা উভয়ভাবে কোনো ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনবে না।
পাঁচ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে লাগবে অনুমোদন
বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা কোনো পরিবারের সদস্যরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একক বা অন্যের সঙ্গে যৌথভাবে বা উভয়ভাবে কোনো ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ারধারক হতে পারবে না বলে আইনে একটি বিধান রাখা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য শেয়ারধারক বলতে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা কোনো পরিবারের সদস্যরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একক বা অন্যের সঙ্গে যৌথভাবে বা উভয়ভাবে কোনো ব্যাংকের মালিকানা স্বত্বের শতকরা ৫ শতাংশের অধিক শেয়ার ধারণকে বোঝাবে।
পর্ষদে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজন থাকা যাবে
সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো একক পরিবার থেকে তিনজনের বেশি সদস্য একই সময়ে কোনো ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকতে পারবে না। আর একজন পরিচালক টানা ১২ বছর কোনো ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন। ১২ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনবছর অতিবাহিত না হলে পরিচালক পদে পুনঃনিযুক্ত হওয়ার যোগ্য হবেন না। এছাড়া একটি ব্যাংকে কমপক্ষে তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক থাকতে পারবে। তবে পরিচালক সংখ্যা ২০ জনের কম হলে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্য সর্বনি¤œ দুজন হবে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক হলে একই সময়ে তিনি অন্য কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি বা এরূপ কোম্পানির কোনো সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনায় এরূপ কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান যা উক্ত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বিমা কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ, যৌথ নিয়ন্ত্রণ বা উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে এরূপ কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকবেন না।
ব্র্যাংক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে টানা ১২ বছর পরিচালক পদে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনবছর গ্যাপ দিয়ে আবার ১২ বছর পরিচালক থাকা যাবে। এ ধরনের বিধান করার মাধ্যমে ব্যাংক মালিকদের ইচ্ছারই প্রতিফলন হয়েছে।
‘আসলে আমাদের দেশে ব্যাংক মালিকরা খুবই শক্তিশালী। এটি ব্যাংকখাতের জন্য ভালো নয়। ব্যক্তিদের জন্য ভালো, তাদের ক্ষমতায় ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারে। লাখ লাখ কোটি টাকা তারা ব্যাংক থেকে নিচ্ছে। একজন আরেকজনকে দেয়। আমাদের দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার পিছনেও ব্যাংকে পারিবারিক আধিপত্যের ভূমিকা রয়েছে।’