অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বছরখানেক আগে পাকিস্তানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় রেকর্ড পরিমাণ। এক কেজি মুরগি কিনতে তখন গুনতে হয়েছে ৫০০-৪৫০ রুপি পর্যন্ত। তবে গত মে মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতি কমে ৩০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে। এতে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রধান খাদ্যপণ্য আটা, মুরগিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যহ্রাস। বর্তমানে ৩৫৫ রুপি বা ১৪৯ টাকায় মিলছে এক কেজি মুরগি। সে হিসেবে এর দাম কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। বাংলাদেশে যদিও এর বিপরীত চিত্র। এক বছরের ব্যবধানে দেশে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি।
পাকিস্তান ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস (পিবিএস) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হাউজহোল্ড ইন্টিগ্রেটেড ইকোনমিক সার্ভে (এইচআইইএস) করে। নিজ দেশের অধিবাসীদের খাবার গ্রহণের ধরনের ওপর জরিপটি পরিচালনা করা হয়। তাতে দেখায় যায়, পাকিস্তানিদের মধ্যে আটা, মাংস ও দুধ গ্রহণের পরিমাণ বেশি। আর মাংসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ব্রয়লার মুরগি। মোট খাবারের ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ জোগানই আসে এ মাংস থেকে। এছাড়া গরু থেকে আসে ১ দশমিক ২৮ শতাংশ ও খাসি বা সমজাতীয় পশু থেকে আসে দশমিক ৬০ শতাংশ জোগান।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে গত বছরের জানুয়ারিতে কেজিপ্রতি মুরগির মাংসের দাম ৬৫০ রুপি ছাড়িয়ে যায়। তখন আশঙ্কা করা হয়েছিল, মুরগির ক্রয়ক্ষমতা মানুষের সাধ্যের অতীত হয়ে উঠতে পারে এবং খুব শিগগিরই গরুর মাংসের মতো দামি হয়ে পড়বে। সে পরিস্থিতি অবশ্য কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে পাকিস্তান। এক বছরের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কমেছে প্রায় ৯০ রুপি।
পিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ১৩ জুন পাকিস্তানের রাজধানী শহর ইসলামাবাদে মুরগির কেজি বিক্রি হয়েছে ৩৬০ রুপি। অন্যান্য রাজ্যে ৩৬০ রুপিতেও বিক্রি হয়েছে। অথচ গত বছরের একই সময়ে মুরগি কিনতে হয়েছে ৪৫৫ রুপি কেজিতে। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দাম কমেছে ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
অন্যদিকে এক বছরে বাংলাদেশে মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ৩০-৪০ টাকা বা ২২ শতাংশের বেশি। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুনে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়। এখন তা ২১০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদের আগে ২৩০ টাকায়ও উঠেছিল।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে পাকিস্তানের মুরগির দাম কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে উৎপাদন ব্যবস্থা সিন্ডিকেটের কবলে পড়ায়। কেননা একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হয় ২৬ টাকা, লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে তা ২৫ টাকা। অথচ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মুরগির বাচ্চার দাম নির্ধারণ করেছেন ৬৭-৭০ টাকা। করপোরেট গ্রুপগুলো আবার তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। একই সঙ্গে পোলট্রি ফিড, এমনকি ডিমও তারা উৎপাদন করছে। যার কারণে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
দেশের মুরগি ও ডিমের বাজার করপোরেট গ্রুপগুলোর নিয়ন্ত্রণে দাবি করে সুমন হাওলাদার বলেন, ‘বাচ্চার জন্য একজন খামারিকে করপোরেট গ্রুপগুলোর কাছে ধরনা দিতে হয়। করপোরেট গ্রুপগুলো তখন বাচ্চার পাশাপাশি তাদের ফিড কেনারও শর্ত দেয়। তা না হলে তারা খামারিদের কাছে বাচ্চা বিক্রি করে না। এসব কারণে উৎপাদন পর্যায়ে খরচ বেড়ে যায়। তাতে স্বাভাবিকভাবেই মুরগির দাম বৃদ্ধি পায়। এ ব্যবস্থাটি বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হলে তবেই দাম কমবে। অর্থাৎ এমন নিয়ম করতে হবে, যিনি বাচ্চা উৎপাদন করবেন তিনি ফিড উৎপাদন করতে পারবেন না। সরকারের পক্ষ থেকে এটি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হলে তবেই বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মুরগির দামও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।’
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে গতকাল দেখা যায়, ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০-২১০ টাকায়। ঈদের আগে বিক্রি হয়েছে ২১০-২৩০ টাকায়। এছাড়া ডিমের ডজন ১৫৫-১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদের আগে ডজনপ্রতি ৫-১০ টাকা বেশি ছিল বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ব্রয়লার হাউজের স্বত্বাধিকারী জাহিদুল ইসলাম জানান, ঈদের আগে ব্রয়লার মুরগির দাম ২১০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন ঈদের ছুটি থাকায় বেশির ভাগ মানুষই গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। যার কারণে চাহিদা না থাকায় মুরগির দাম কিছুটা কমেছে। রাজধানী কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবার দাম বাড়তে পারে।
ডিমের দামও ওঠা-নামার মধ্যে রয়েছে। গত বছরের ঠিক এ সময়ে বাজারে ডিমের ডজন ১৩৫-১৪০ টাকা থাকলেও গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ১৫৫-১৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঈদের ছুটি শেষে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিত্য এ পণ্যটির দামও বেড়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন কারওয়ান বাজারের ডিম বিক্রেতা প্রদীপ।
করপোরেট গ্রুপ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুনাফার প্রতি লোভ বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আছি। সরকারের জোর-জবরদস্তি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর জন্য বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের সৎ হতে হবে।’