কার্তিক-অগ্রহায়ন দুই মাস হেমন্তকাল। ঝতুচক্রে এখন অগ্রহায়ন মাস চলমান। এ বছর হেমন্তের মাঝামাঝি থেকেই হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে।একইসঙ্গে প্রকৃতিতে শিশির জানান দেয় শীতের আগমনী বার্তা। সকাল ও রাতে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় মোড়ানো থাকছে উত্তরাঞ্চল। আর সেই শীতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা খেজুর রস থেকে এরই মধ্যে রায়গঞ্জের সোনাখাড়া ইউনিয়নের গোতিথা গ্রামে খেজুর রসের পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা। খেজুরের পাটালি গুড় তৈরি যেন এক মহাযজ্ঞ। রায়গঞ্জের কয়েকটি গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, খেজুর রস থেকে গুড় তৈরিতে গাছিদের নানান কর্মকান্ড। প্রকৃতির পালাবদলে এখন গ্রামের ঘরে ঘরে খেজুর গুড়ের পিঠা,পায়েস, গুড়ের মুড়ি -মুড়খি ও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়ছে। সম্প্রতি দিন যত যাচ্ছে শীতের আবহ বেড়েই চলছে। শীতের আগমনে বেশ কিছুদিন ধরেই শুরু হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ। প্রতি বছরের মতোই কার্তিক মাস (অক্টোবর-নভেম্বর) থেকে রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজ করে আসছেন গাছিরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতেই মাটির ভাঁড়ে রাতভর রস সংগ্রহ করা হয়।ভোরের সূর্য ওঠার আগে গাছিরা রস ভর্তি মাটির ভাঁড় গাছ থেকে নামিয়ে পরে মাটির হাঁড়িতে কিংবা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বাল দেওয়া হয়। এতে রস শুকিয়ে তৈরি করা হয় পাটালি গুড় ও লালি গুড় নতুন খেজুর রসের পাটালি গুড় তৈরির পর তা চলে যাচ্ছে বাজারে। রস সংগ্রহ গুড় তৈরি ও বাজারে বিক্রি করতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন গাছিরা। প্রায় আঠারো বছর ধরে রায়গঞ্জে খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে পাটালি গুড় তৈরি করছেন রাজশাহী জেলার বাঘা থানার গাছি মোঃ মিনারুল ইসলাম। এবারও পাটালি গুড় তৈরিতে কাজে চলে এসেছেন রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের গোতিথা গ্রামে মোঃ রাকিবুল ইসলাম তার সঙ্গে গুড় তৈরির কাজ করে আসছেন নিয়মিতভাবে। গাছি মোঃ মিনারুল ইসলাম ও মোঃ রাকিবুল ইসলাম জানান, তারা দুইজন এবার মোট প্রায় ২০০ টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করার উপযোগী করেছেন। সংখ্যায় অনেক বেশি গাছ হওয়ায় তারা আশ্বিনের শুরুতে গোতিথা গ্রামে এসে গাছ পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছেন।প্রস্তুত করা প্রতিটি গাছ থেকে সপ্তাহে তিন-চারদিন রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছে শুরুতে এক থেকে দুই কেজি করে রস সংগ্রহ হলেও আস্তে আস্তে তা বাড়ে। প্রতিদিন ধাপে ধাপে গাছের রস সংগ্রহ করেন তারা। গাছিরা জানান, প্রায় আঠারো বছর ধরে তারা রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের গোতিথা গ্রামে নিয়মিত আসেন খেজুর রস থেকে গুড় তৈরির কাজে।এটিই তাদের ব্যবসা। স্থানীয় বাসিন্দাদের খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে পাটালি গুড় ও লালিগুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছেন তারা। রস উৎপন্ন করতে গাছের পরিচর্যায় প্রচুর সময় লাগে, তাই সব মিলিয়ে চার মাস তাদের রায়গঞ্জে থাকতে হয়। তারা আরও জানান, প্রথম দিকে প্রতিদিন আনুমানিক পাঁচ কেজি করে পাটালি গুড় তৈরি হয়।তারপর মাঝামাঝি থেকে পুরো মৌসুমে প্রতিদিন ৫০কেজি থেকে ৬৫ কেজি পাটালি গুড় তৈরি করা হয়। মানভেদে প্রতি কেজি পাটালি গুড় পাইকারিদের কাছে বিক্রি করা হয় ২০০থেকে ২৫০ টাকা। লালিগুড় মানভেদে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। গাছ মালিকদের বিষয়ে জানতে চাইলে জানান, রস থেকে গুড় তৈরির জন্য স্থানীয়দের মোট ২০০ টি গাছের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করা আছে তার। এর মধ্যে কোনো ব্যাক্তির একটি,দুটি, পাঁচটি বা ১৫-২০ টি, আবার কারোও ২০-৩০ টি করে গাছ রয়েছে। তাদের এ মৌসুমে প্রতিটি গাছের জন্য ৩০০-৪০০ টাকা বা দুই থেকে তিন কেজি পাটালি গুড় দিতে হবে এমন চুক্তি করা হয়েছে। তবে এ বছর গুড় তৈরির জ্বালানির জন্য বেশি দাম গুনতে হচ্ছে তাদের। জ্বালানি হিসেবে তারা আগে খড় কুটা ব্যবহার করতো কিন্তু এখন সেগুলো ঠিক ভাবে না পাওয়ার কারনে তারা কাপড়ের জুট ব্যবহার করে থাকেন।আগে যে দাম দিয়ে জুট কাপড় কিনতো এখন তার থেকে বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। গাছি মোঃ মিনারুল ইসলাম জানান, খেজুর গাছ তৈরির প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করার পর থেকেই মূলত রস নামানোর পর্ব শুরু হয়। গাছের মাথার নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের তৈরি পেরেক পোঁতা হয়। সঙ্গে দড়ি বা সুতা বেধে মাটির পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছের সাথে। পাত্রের ভেতর রস পড়ার জন্য বাঁশের তৈরি নালার মতো ভিন্ন একটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়। এভাবেই নিপুন হাতের ছোঁয়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে খেজুরের রস। তিনি ও রাকিবুল ইসলাম প্রতিদিন দুপুরের দিকে নির্দিষ্ট গাছগুলোতে উঠে তাতে হাঁড়ি ঝুলিয়ে আসেন। এরপর রাত ২ টার দিকে গিয়ে গাছে উঠে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বালিয়ে পাটালি গুড় ও লালি গুড় তৈরির কাজে নেমে পড়েন। গাছিরা জানান, গুড় তৈরির জন্য শুরুতে টিনের তাওয়াতে রস দিয়ে আগুনে তাপানো হয়। এ সময় তাওয়াতে থাকা রস অনবরত নাড়তে হয়। তারা জ্বালানি হিসেবে কাপড়ের জুট ব্যবহার করে থাকেন। রস ৩-৪ ঘন্টা জ্বাল করানোর পর রস ঘন হয়। এরপর তা নামিয়ে একটি গোলাকার হাঁড়িতে ঢেলে বাঁশের একটি সরু লাঠি দিয়ে ঘোরানো হয়। এক পর্যায়ে সেগুলোর ঘনত্ব আরও বেশি হয় এবং তা কাঠের তৈরি চারকোনা বিশিষ্ট বক্সের মধ্যে ঢেলে ঘন্টা খানেক সময় রেখে দিলেই হয়ে যায় পাটালি গুড়।