‘মোনঘর’ আমার কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠধন; যাকে আমি লালন করেছি প্রথম যৌবনে ঘরে আনা নতুন বউয়ের মতো। যদিও দূরে আছি তবু মোনঘর মিশে আছে আমার রক্তের প্রতিটি কোষ আর চিন্তার শিরা-উপশিরা ছুঁয়ে সর্বত্র। ১৯৭৪ থেকে ২০২৪ খিষ্টাব্দ; এ বছর মোনঘর উদযাপন করেছে পথচলার ৫০ বছর। মোনঘরের একজন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি এখনও পৃথিবীর আলো বাতাসে বেঁচে আছি-সব যেন আমাকে বিস্মিত করে!
‘মোনঘর’ ইংরেজীতে আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘হিল হোম’। ‘মোন’ মানে হিল আর ‘ঘর’ মানে হোম। এ ‘মোনঘর’ নামকরণের পেছেনে জুম কালটিভেশন বা শিফটিং কালটিভেশনের বহু ঐতিহ্যিক ও বহু নানন্দিক পিছুটানের প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়েছে। এই নামের সাথে মিশে আছে নস্টালজিক অতীত স্মৃতি বিধুর আনন্দ বেদনার প্রীতিরূপের বহিঃপ্রকাশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভাষাভাষী ১২টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। তাঁরা জুম কাটতো মূল গ্রাম বা পাড়া থেকে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। চৈত্রের শেষভাগে সেই জুম পোড়াতো। বৈশাখের প্রথম ভাগে পোড়া আগাছা বাছাইয়ের পর ধান, তীল, মারপা, চিনার, ভূট্টা প্রভৃতি বীজ একত্রে মিশিয়ে বীজ বুনতো। সাথী ফসল হিসেবে বুনতো মরিচ ও কাঁকনের বীজ। বুনতো সত্রং ফুলসহ নানাবিধ ফুলের বীজ। এসব বোনা বীজ সময়ানুগ দেখাশোনা, পরিচর্যা থেকে শুরু করে পরিপক্ষ ধান ভাণ্ডারে ওঠানো পর্যন্ত সময়কালের জন্য একটা অস্থায়ী ঘর তৈরী করতো। এই অস্থায়ী আবাসটিই হলো ‘মোনঘর’। এই মোনঘর তৈরীর সময় জুমচাষীর স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের সঠিক বাস্তবায়নের কর্মকৌশল মনের মণি কোঠায় কাক্সিক্ষত প্রত্যাশারূপে বিরাজমান থাকতো-এ বছরের এ জুম থেকে সম্বৎসরের খোরাকী অবশ্যই সংগৃহীত হবে। চাহিদা মিটবে গোটা বছরের অপরাপর নিত্য নৈমিত্তিক তরি-তরকারী ও ফলমূলের।
আমাদের এ প্রতীকি মোনঘরেও তিন পার্বত্য জেলার দশ ভাষাভাষী বারোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল, অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠা শিশু সন্তানরা আশ্রয় পাবে; তাদের সারা জীবনের খোরাকী সংগ্রহ করবে মোনঘর থেকে। আমাদের স্বপ্নের ‘মোনঘর’ তাদেরকে গড়ে তোলবে শিক্ষায়-দীক্ষায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, আচার-ব্যবহারে, চিন্তায়-চেতনায়, ধ্যান-ধারণায়, নৈতিক এষণায়। সর্বোপরি সামাজিক, নৈতিক, মানবিক কর্মকাণ্ডে আত্মনিবেদিত, আত্ম বিশ্লেষণী শক্তিসম্পন্ন ভাবী প্রজন্মে আর্শিবাদ হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিত্বে রূপান্তরণের পথ ও দিক নির্দেশনা দেবে মোনঘর।
খ.
আমাদের লালিত স্বপ্নের ঠিকানা ‘মোনঘর’ এর প্রারম্ভিক পর্বের ইতিহাস কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। অভিধানিকভাবে আমরা সবাই জানি এর প্রতিষ্ঠার তারিখ ১৯৭৪ সাল। মূলত: পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম থেকে পরমারাধ্য গুরু ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো মহোদয়ের বিদায় ও তদস্থলে অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে ডেকে ঐ প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত করার তারিখটিই মোনঘর প্রতিষ্ঠাতার ১৯৭৪ সাল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। সে বছর পরমারাধ্য গুরু চিরতরে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম ত্যাগ করে মাইনী মুখ হয়ে লঞ্চ যোগে রিজার্ভ বাজার লঞ্চ ঘাটে এসে পৌঁছেছিলেন। আমি ও অগ্রজ বিমল তিষ্য ভিক্ষু লঞ্চ ঘাটে তাঁকে গ্রহণ করে রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহারে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করেছিলাম। সেদিনের রাত্রে অগ্রজ বিমল ভান্তে ও আমি তখনকার অভিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রাজধানী রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের শাখা কার্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরমারাধ্য গুরু ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো মহোদয়ের কাছে ১০,০০০/ (দশ হাজার) টাকা চেয়েছিলাম। পরমারাধ্য গুরু আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে নগদ ১০,০০০(দশ হাজার) টাকা প্রদান করে আমাদের উপর আস্থা ও বিশ্বাসের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন।
গুরু ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো প্রদত্ত ঐ টাকা দিয়ে অনুজ প্রিয় তিষ্য ভিক্ষুর (বর্তমান শ্রী সজ্জন চাকমা) আত্মনিবেদিত উদ্যোগে মি. খচ্চুয়া চাকমার নিকট হতে দু’একর ও মি. বুদ্ধমনি চাকমার নিকট দু’একর স্থাপনা নির্মাণোপযোগী পাহাড় ক্রয় কার্যক্রম সম্পন্ন হয় দীর্ঘ দুই থেকে আড়াই বছর পর। এ দু’ আড়াই বছরের মধ্যে কিন্তু সর্ব প্রথম ‘রাঙ্গাপানি মিলন বিহার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রাঙ্গাপানি মিলন বিহার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাবু সুরত চন্দ্র চাকমা পাঁচ শতক ও বাবু খচ্চুয়া চাকমা পাঁচ শতক জায়গা বৌদ্ধিক নিয়মে ভিক্ষু সংঘ ডেকে পুণ্যানুষ্ঠানসহ জল তর্পণ পূর্বক দান করেছিলেন। তাঁদের দানকৃত জায়গার উপরই সর্বপ্রথম রাঙ্গাপানি মিলন বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রাঙ্গাপানি মিলন বিহারে অনুজ প্রিয়তিষ্য ভিক্ষু অধ্যক্ষ পদে ব্রতী থাকাকালীন পূর্বে বর্ণিত দু’জন প্রিয় ভাজন দায়কগণের কাছ থেকে চার একর পাহাড় জমি ক্রয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।
রাঙ্গাপানি ও ভেদভেদী বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধ গ্রামদ্বয়ের মাঝামাঝিতে অবস্থিত রাঙ্গাপানি মিলন বিহারকে কেন্দ্র করে একটি এল সাইজের গাছের খুটি, বাঁশের বেড়া, ছনের ছাউনিযুক্ত ডরমিটরি ঘরে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের শাখা কার্যালয়ের শুভ যাত্রা সূচিত হয়। রাঙ্গাপানি মিলন বিহার প্রতিষ্ঠিা, এ বিহারে অনুজ প্রিয়তিষ্য ভিক্ষু অধ্যক্ষ হিসেবে ব্রতী হয়ে আসা এবং পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের শাখা কার্যালয় প্রতিষ্ঠাÑএই তিনটি বিষয় মোনঘর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরস্পরা হিসেবে কাজ করেছে। মূলত: উল্লেখিত তিনটি ঘটনার ধারাবাহিকতা নির্ভরতা না ঘটলে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের শাখা কার্যালয় ঘিরে ১৯৭৯/৮০ সালের দিকে ‘মোনঘর’ নামক প্রতিষ্ঠানটির আলোর মুখ দর্শন হয়তো সুদুর পরাহত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো।
অতএব ‘মোনঘর’ প্রতিষ্ঠার পেছনে আমার চাইতে অনুজ প্রিয় তিষ্য ভিক্ষুর অবদান অবিস্মরণীয় ও অমোচনীয়। তার সঙ্গে বাবু সুরত চন্দ্র চাকমা (সুরতন বাবু) ও বাবু খচ্চুয়া চাকমার অবদানও অনেকাংশে অনুজ প্রিয়তিষ্য ভিক্ষুর অবদানের সমতুল্য। কারণ, তাঁরা উভয়ে রাঙ্গাপানি মিলন বিহার প্রতিষ্ঠার জন্য দশ শতক জায়গা জল তর্পন পূর্বক দানকার্য সম্পাদন না করলে স্বপ্ন সম্ভাবনার মোনঘর-‘আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন বাতাসে’ এরূপ অবস্থায় থেকে যেতো বছরের পর বছর আর যুগের পর যুগ।
আমি ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো একজন স্বপ্নবাজ ভবঘুরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরূপী গাধা। আসল গাধারা শুধু ভার বহন করে। কিন্তু আমি গাধা কোন দায়িত্ব কাঁধে বর্তালে সেই দায়িত্ব আমার আশে-পাশের করিৎকর্মা বিশ্বস্তজন ম-লীকে যথাযথভাবে কাজে সম্পৃক্ত করে বর্তিত দায়িত্বটি পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ আমার দৃষ্টিতে ‘একা শয্যে তেল নয়, একা মানুষ মানুষ নয়’। উপরতলার ও নীচ তলার সব মানুষ যাঁরা আমার দৃষ্টিতে কল্যাণময় মানবিক কর্মযজ্ঞে সাহায্য-সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারণে পারঙ্গম তাঁদেরকে স্বমতে এনে কার্য হাসিলই ছিল আমার তপস্যা বা আরাধনা। এতে আমি কতটুকু সফল হয়েছিলাম তা-ই ইতিহাস হয়তো একদিন মূল্যায়ন করবে। নিরূপন করবেন যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসবেত্তা কেউ থেকে থাকেন। মোনঘরে আমার দায়িত্বে ব্রতী থাকার ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯৭৪ সাল হতে ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত বলা যায়-৩২ থেকে ৩৪ বছর মাত্র।
‘মোনঘর’ নামক প্রতিষ্ঠানটি ছিল আমার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, স্বপ্ন সারথী অনেকটা বিয়ে করা বৌ এর মতো। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল মোনঘরের কার্যক্রম নিভু নিভু অবস্থায় ছিল। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত ছিল মোনঘরের স্বর্ণ যুগ। ১৯৮৫ সাল হতে মোনঘরে অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভাষাভাষী ১২টি আদিবাসী বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রী যারা অর্থ কষ্টে উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহণ সুদূর পরাহত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছিল তাঁদেরকে আহরণ ও আহ্বান করে উচ্চ শিক্ষা বৃত্তি প্রদান কার্যক্রম শুরু করি। ১৯৯৭ সালে এসে উচ্চ শিক্ষায় বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৩০০ (তিনশত) জনে। ১৯৯৭ সালের ১লা মার্চ হতে ১৯৯৯ সালের জুন পর্যন্ত মোনঘর আমার তত্বাবধানে ছিল না। ১৯৯৯ সালের জুলাই হতে ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত মানঘর আবার আমার তত্বাবধানে আসে। এসময় মোনঘর তখনকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বর্ষীয়ান নেতা বাবু কল্প রঞ্জন চাকমার বদান্যতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এ প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা ছিলেন বাবু প্রীতিকান্তি ত্রিপুরা আর উপ-প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বাবু শুভ্রাংশ চাকমা (বর্তমানে প্রয়াত) মহোদয়।
২০০৭ সালের দিকে তত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আর্থ-সামাজি উন্নয়ন প্রকল্পটির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষিত হয়।
মোনঘরের কার্যনির্বাহী পরিষদে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বেব্রতী হওয়ার পর থেকে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ মার্চ অব্যাহতি গ্রহণের ব্যাপ্তিকাল পর্যন্ত আমার কার্যকাল ৩৪ (চৌত্রিশ) বছরের কম-বেশি হতে পারে। আমার কার্যকালে মোনঘরের পথ চলা পুষ্প বিছানো ছিল না। দীর্ঘ কুড়ি বছরের ইনসার্জেন্সি পিরিয়ডকে বুকে ধারণ করে আমার নেতৃত্বে মোনঘরের পথ চলা ছিল নানা কিসিমের চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করণ, জীবন বাজি রাখার মতো অকুতোভয় আবহকে আবাহন ও তাকে বিচক্ষণতা এবং উপস্থিতি বুদ্ধি বলে উত্তরণ স্পৃহাকে পূঁজি করে কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেওয়ার কাল। কীভাবে যে সেই দুরূহ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়েছিল তা এক্ষণে খুবই অভাবনীয় ও অলৌকিক মনে হয়। এজন্যে আমার অগ্রজ বিমল ভান্তে ও অনুজ শ্রদ্ধালংকারসহ কিঞ্চিদধিক ১৮ জন বৌদ্ধ ভিক্ষু, মোনঘর আবাসিক স্কুলের তাবৎ শিক্ষক-শিক্ষিকা মণ্ডলী ও রাঙ্গামাটির বহু ঐতিহ্যমণ্ডিত আনন্দ বিহারের এবং রাঙ্গামাটি শহরের বহু সহস্রাধিক শিক্ষিত, দূরদর্শী, বিচক্ষণ বৌদ্ধ দায়ক-দায়িকাগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবো। কৃতজ্ঞতার পাশে চির আবদ্ধ রাখবো তখনকার সময়ের বাঙ্গালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, চাকমা বৌদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ বাঙ্গালী ব্যবসায়ী মহলকেও সময়ানুগ সাহায্য সহযোগিতার জন্য। মোনঘরের সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভ সন্ধিক্ষণে তাঁদের সকলের সার্বিক মঙ্গল কামনা করি।
এতক্ষণ যা বললাম তা আমার বা আমাদের মোনঘর। তথাপি ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ হতে বর্তমান ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোনঘরের হাল অবস্থা সম্বন্ধে মন্তব্য করার যোগ্যতা নেই বিধায় তা থেকে দূরে থাকাটা আমার জন্য নিরাপদ মনে করি।
গ.
মোনঘরের স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলবো-অগ্রজ বিমল তিষ্য ভিক্ষু ছিলেন একজন যথার্থ স্বপ্নবাজ বৌদ্ধ ভিক্ষু। ঢাকার পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ ছিল তাঁর স্বপ্নের ফসল। কলকাতায় বোধিচারিয়া কমপ্লেক্স হল তাঁর আরেকটি স্বপ্নের ফসল। ‘মোনঘর’ হল অগ্রজ বিমল তিষ্য ভিক্ষু ও আমার মিলিত স্বপ্ন সম্ভাবনার একটি পরশ পাথর যা আমাদেরকে ভবঘুরে অবস্থায়ও স্বপ্ন বিলাসী জীবন বেছে নিতে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন বিলাসটা ছিল বাস্তব সঞ্চারী। বিশে^র মানবতাবাদী জনগণ, মানব দরদী এনজিও, দেশে ও বিদেশের প্রজন্ম ভাবনায় আত্মগত, আত্ম নিবেদিত জনগণই হলেন আমাদের স্বপ্ন সম্ভাবনার কাণ্ডারী ও পথ প্রদর্শক। এঁদেরই মিলিত বদান্যতার ফসল হল মোনঘর। মোনঘর’র একটি থীম সং রয়েছে। এ গানটির রচয়িতা আমার প্রখ্যাত বন্ধু মি. সুগত চাকমা (ননাধন)। বন্ধুবর কবি, সাহিত্যিক ও প্রখ্যাত ইতিহাস বেত্তা। তাঁর রচিত এ থীম সং এর মধ্যে মোনঘরের সার্বিক পথ চলার পথ নির্দেশটি বিধৃত রয়েছে। এখানে ননাধনের থিম সংটি উল্লেখিত-
আমা জাগা আমা ঘর
আমা বেঘ’ মোনঘর
সুখে দুখে ইধু থেই
বেক্কুন আমি ভেই ভেই
ইধু থেলে এ জনম
পেবং আ-র গমে পহর
(আমা বেঘ’ মোনঘর)
নমো বুদ্ধর পধ দরি
এ-য বেঘে কাম গরি
মধ্য পধে হাদি যেবং
ন থেবদে কোনো দর
(আমা বেঘ’ মোনঘর)
বুদ্ধ পুজি সুখ পেবং
সর্ব দুঃখ পার হবং
সর্ব কালত তরিবং
পুন্য পেবং জনমভর
আমা বেঘ’ মোনঘর
বস্তুতঃ করুণাঘন বুদ্ধের মধ্যম পন্থাই ছিল মোনঘরের পথ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন-সারথী ও আলোকবর্তিকা।
এছাড়াও মোনঘরের একটি স্বপ্ন ছিল সে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতন হবে। এখানে প্রি-ক্যাডেট স্কুল থাকবে, থাকবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ, ডিগ্রী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থাকবে। এছাড়াও থাকবে বহু মাত্রিক টেকনিক্যাল ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট, পালি মহাবিদ্যালয়, আরও কত কি! মোনঘর হবে অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বাতিঘর। চিন্তাশীল, বুদ্ধিদীপ্ত দূরদর্শী প্রজন্মের আড্ডার আসর বসবে এখানে। সেটা আবার মদের আসর নয়! এখানকার আড্ডা ও আসরে ভাবিত চিত্তের সমন্বয় ঘটবে।
চিন্তা চর্চা, বিদ্যাচর্চা, জ্ঞানচর্চা ও প্রজ্ঞাচর্চার মধ্য দিয়ে সমাজ দেহের বহু দিনের জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা কুসংস্কার সমূহ যা আদিবাসী বৌদ্ধ সমাজকে অন্ধকার জগতে রেখে দিয়েছে মোনঘরের বদান্যতায় সে সব দূরীভূত হবে। এ রকম বহু সহস্র মঙ্গলকাক্সক্ষায় ভরপূর ছিল আমার প্রত্যাশার মনোভূমি। তার কিছু কিছু স্বপ্ন ও লক্ষ্য সীমিত পরিসরে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে পরিপূরণের উৎসর্জন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল-তা আমার অবর্তমানে অব্যাহত রাখা হয়েছিল কিনা জানি না। ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড় যুগের কাছাকাছি মোনঘর থেকে বিচ্ছিন্ন বিধায় মোনঘরের লালিত স্বপ্ন ও লক্ষ্য কতটুকু পূর্ণতা পেয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে মোনঘরের জন্য এ বৃদ্ধ বয়সেও আমার কোচ্পানা ফল্গুধারার মতো অন্তঃসলিলা অবস্থায় বহমান রয়েছে, থাকবে চিরকাল।
গ.
আমি একজন ভবঘুরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। এ সন্ন্যাস জীবন কতটুকু কার্যকররূপে আমার জীবন তরঙ্গে প্রতিভাত ও আলোড়িত হয়েছিল সে বিষয়ে বহু বিদগ্ধ জনের নিন্দা ও প্রশংসার যুগপৎ উচ্চারণ গুঞ্জরিত শোনা যায়। এসবই আমাকে খুব বেশি আন্দোলিত না করলেও বেদনাহত করে। আমার বোধ-বুদ্ধি ও অন্তর্লীন সহজাত প্রর্বতনা বা স্বজ্ঞা-সংজ্ঞা নির্দেশ করে যে, আমি একজন সত্যানুসন্ধানী জ্ঞানান্বেষণে সদা উৎসর্জিত শিশিক্ষু ছাত্র যা আমাকে ইউরোপের বিখ্যাত দার্শনিক আদে্রঁ জিদের সেই মহান উক্তিকে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেই উক্তিটি হল ‘আমি যা তার জন্য নিন্দিত হতে রাজি আছি। কিন্তু আমি যা নই তার জন্যে প্রশংসিত হতে চাই না; কোন মতেই’ । ভণ্ডামী আমার দু’চোখের বিষ। কাউকে তৈল মর্দ্দন, চাটুকারিতা, পদলেহন স্পৃহা নেই বিধায় অনেকের কাছে আমি ফালতু, অপদার্থ ও বেকুব। আমার যা রয়েছে তাতে আমি সন্তুষ্ট থাকি বিধায় আমি সুযোগ সন্ধানী নই। মোদ্দা কথায় যে দায়িত্বে আমি ব্রতী হই অন্তর দিয়ে, হৃদয়বত্তা দিয়ে, জবাবদিহিতা দিয়ে, সর্বোচ্চ অধিগত বিচক্ষণতা, চিন্তাশীলতাকে পূঁজি করে সংশ্লিষ্ট সকলের সম্ভাবনাজাত শক্তিমত্তাকে নিংড়ে নিয়ে যথাযথভাবে সেই সব কার্য হাসিলের চেষ্টার কোন ত্রুটি আমি রাখি না। উদ্ভূত সমস্যা সমূহের গভীরে গিয়ে সমস্যা উত্তরণের যত প্রকার সম্ভাব্যতা আমার অভিজ্ঞতার ভা-ারে জমা থাকতো তাই দিয়ে মোকাবেলা করার প্রয়াস চালাতাম। সমস্যাকে জিইয়ে রেখে তা আরও গভীর এবং অপ্রতিরোধ্য করার অভিপ্রায় কোন কালেই আমার ছিল না। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ, বেনামী চিঠির কালো চক্রান্তে মোনঘর, মোনঘর শিশু সদন, বনফুৃল শিশু সদন (বনফুল চিলড্রেন্স হোমস), পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ বাংলাদেশ অর্থাৎ সকল প্রতিষ্ঠান থেকে জার জবরদস্তি মূলকভাবে আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কোন রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে জোর জবরদস্তি মূলকভাবে অব্যাহতি নেওয়ার অপ্রতিরোধ্য পরিবেশ সৃষ্টি হলে বিনা বাক্য ব্যয়ে ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ অব্যাহতি পত্রে স্বাক্ষর করেছিলাম। হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে আমাকে তিন মাস সময় দেওয়া হলেও আমি মাত্র তিন দিনের মধ্যে সমস্ত হিসাব ট্রানজিশন কমিটির সভাপতি ড: প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমার হাতে বুঝিয়ে দেই। শুধুমাত্র ভিক্ষুদের নিত্য ব্যবহার্য ভিক্ষা পত্র ও ত্রিচীবর সম্বল করে ১৯৯৭ সালের ২০ মার্চ রাঙ্গামাটির আনন্দ বিহারের উদ্দেশে ঢাকার শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার ত্যাগ করেছিলাম। অব্যাহতি গ্রহণের পর আমার বিরুদ্ধে বেনামী চিঠির যে বন্যা বয়ে গিয়েছিল তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়! নিয়তির কি নির্মম পরিহাস!! এসকল বনামী চিঠির বন্যা যারা বইয়ে দিয়েছিল তাদেরকে আমি চিনি। তারা আমার দৃষ্টিতে নপুংসক। মনুষ্য নামের কলঙ্ক। কারণ, পনের লক্ষ আদিবাসী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিকট প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো একটি ক্ষুদ্র বিন্দু মাত্র। প্রজ্ঞানন্দের দ্বারা আদিবাসী বৌদ্ধ সমাজে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলে, তাকে চিরতরে নেই করে দিতে ক্ষতি কি? তবে নিরানব্বই শতাংশেরও বেশি আদিবাসী বৌদ্ধ এ প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার সাথে জড়িত ছিল না। ছিল মাত্র জনদশেক অকৃতজ্ঞ মনুষ্যরূপী কাপুরুষ।
১৯৯৯ সালের ১ লা জুলাই, উপরে উল্লখিত সকল সংগঠনের দায়িত্বে ব্রতী হওয়ার সর্বসম্মত প্রস্তাব আবার আমার কাছে উপস্থাপিত হলে গ-মূর্খ গাধা বিধায় শর্ত সাপেক্ষে তা গ্রহণ করতে দ্বিধা করিনি। কারণ, আমার মতো ভবঘুরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দু’কান কাটা, দ্বিতীয়বার নেড়া বেল তলায় যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত গাধা দ্বিতীয়জন এ ভব সংসারে আছেন কি না-আমার জানা নেই। এ নাখান্দা, না লায়েক ন্যাড়া বেল তলায় দ্বিতীয়বার যাওয়ার অব্যবহিত পর পরই চাকমা সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত সরকারী কর্মকর্তা (রাষ্ট্রদূত) মহোদয় যে উন্নয়ন সহযোগীগণ আমাকে দ্বিতীয়বার বেল তলায় নিয়েছিলেন তাদের উদ্দেশে এমন একটি চিঠি লিখেছিলেন। চক্রান্তমূলক এই চিঠির অভিঘাতে শুধু আমি নই এতদ্সঙ্গে মোনঘর, মোনঘর শিশু সদন, কাচালং শিশু সদন, গিরিফুল শিশু সদন, ঢাকাস্থ বনফুল চিলড্রেন্স হোমস এর কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৩০০(তিনশত) জন ছাত্রছাত্রীর উচ্চ শিক্ষা বৃত্তি প্রদান কার্যক্রম চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ২০০০ সালের দিকে তখনকার সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মি. কল্পরঞ্জন চাকমা মহোদয় সার্বিক সহযোগিতার বার্তা নিয়ে আসেন। মূলত: কল্পরঞ্জন চাকমা মহোদয়ের আন্তরিকতা, সদাশয় সরকারের আর্থিক বদান্যতার বাতাবরণের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙ্গামাটি কর্তৃক মোনঘর, কাচালং, গিরিফুল ও বন্দরবান বৌদ্ধ অনাথালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ না করলে এতদিন হয়তো আমার কবরে মহামহীরুহ রূপে বট বৃক্ষের আবির্ভাব শোভা বর্ধন করতো।
২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সালের দিকে তত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতাগ্রহণ পর্যন্ত মোনঘর, কাচালং, গিরিফুল ও বান্দরবান বৌদ্ধ অনাথালয়টি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের তত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছিল। ৩০০ (তিনশত) জন মেধাবী ছাত্রছাত্রীর উচ্চ শিক্ষাবৃত্তি প্রদান কার্যক্রমও অব্যাহত ছিল বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস।
২০০৭ অথবা ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হচ্ছে-এরূপ জানতে পেরে আঞ্চলিক পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান বাবু জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে (সন্তু লারমা) মহোদয়ের রাঙ্গামাটিস্থ প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে বন্ধুবর বাবু দীপায়ন খীসা ও বন্ধুবর বাবু ত্রিজিনাদ চাকমাকে স্বাক্ষী রেখে বলেছিলাম-‘স্যার, আমি প্রজ্ঞানন্দ কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নই কারণ আমি রাজনীতি বুঝি না। বুঝার চেষ্টাও করি না। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি অথবা ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট যারা বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে তাঁরই সরকারের পবিত্র সান্নিধ্যে ও বদান্যতায় মোনঘরকে টিকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টায় আত্মগত থাকবো। কারণ আমি তিন পার্বত্য জেলার সবক্ষেত্রে অনগ্রসর বৌদ্ধ-অবৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মেধাবী সন্তান-সন্ততিকে শিক্ষা-দীক্ষায় বিম-িত করে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিশ্রুতিশীল দেশপ্রেমিক প্রজন্ম বির্ণিমানই আমার ধ্যান-জ্ঞান ও একমাত্র আরাধনা।’ ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ, অদৃশ্য সুতোর টানে মোনঘরের দায়িত্ব দ্বিতীয়বার আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। মোনঘরের দায়িত্বে আমার ব্রতী থাকাকালীন ৩৪ বছরের মধ্যে মোনঘরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটুকু পূর্ণতা পেয়েছিল-তা ইতিহাস নির্ভর। এর স্বপক্ষে আমার মন্তব্য বা কোনকিছু বলা নিজের ঢোল নিজে পেটানোর বিষয়টি এসে যায় বিধায় তা থেকে বিরত থাকাটা যৌক্তিক ও নিরাপদ মনে করি।
ঘ.
‘মোনঘর’ একটি অরাজনৈতিক ও অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন হিসেবে সদাশয় সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন প্রাপ্ত অনাথ আশ্রম। গঠনতন্ত্রে মোনঘরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুষ্পষ্টভাবে বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। গঠনতন্ত্রটি তখনকার সময়ের ব্যক্তিত্ববান সমাজ চিন্তক, সমাজ সংস্কারক, সমাজ উন্নয়নে আত্মনিবেদিত দিক পাল পথ প্রদর্শক কর্তৃক আলোচিত পর্যালোচিত যদ্দুর সম্ভব আমার দৃষ্টিতে সর্বজন গ্রাহ্য গঠনতন্ত্র। এখানে বৌদ্ধিক চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা সহগত চিত্ত-সন্ততির উৎসর্জনের বিষয়টি ও গঠনতন্ত্রে প্রচ্ছন্নভাবে সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন রাজনীতিমুক্ত ও ধুমপান মুক্ত, তেমনি আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের সম্যক জীবিকার বিষয়টিও মাথায় নিয়ে শিরোধার্য হিসেবে রেখে আশ্রিত প্রজন্মের পবিত্র জীবন বিধান গড়ে তোলার লক্ষ্য ও আদর্শ সহজাতভাবে প্রবহমান ছিল শতভাগ। কারণ, মোনঘর প্রতিষ্ঠিত করেছিল ভবঘুরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাই এখানে পঞ্চ বাণিজ্যের কোন সংযোগ থাকবে না-স্বতঃসিদ্ধ। বর্তমান মোনঘরের শিখণ্ডীরা যদি প্রাণী, মাংস, অস্ত্র, বিষ ও মাদক এ পঞ্চ নিষিদ্ধ বাণিজ্যের প্রর্বতন অথবা নিজেরা সেখানে বসে মদের আসর বসায় তাহলে তা মোনঘরের লক্ষ্য ও আদর্শ বিরোধী হবে নিঃসন্দেহে। ‘দি মোনঘরীয়ান্স’র অন্তর্ভূক্ত প্রাক্তনীগণ মোনঘরেই সুবিধাভোগী উচ্চ শিক্ষিত স্ব স্ব কর্ম ক্ষেত্রে যথাযোগ্য দায়িত্ব ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত স্বয়ং সম্পূর্ণ এক একজন সুপ্রতিষ্ঠিত সুনাগরিকের একক। তাঁদের মধ্যে চিন্তা চেতনাজাত, ধ্যান-ধারণাগত মনোজাগতিক ঐক্য দৃঢ়ভাবে মিলিত হলে মোনঘরকে আর পেছেনে ফিরে তাকাতে হবে না। ‘মোনঘর’ গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আমাদের প্রাণ প্রিয় বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল জনগোষ্ঠীর ‘বাতিঘর’ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করবে যদি তাঁরা অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোনঘরকে সংজ্ঞায়িত করে ত্যাগ স্বীকার করে। দি মোনঘরীয়ান্স ও মোনঘর এর ৫০ (পঞ্চাশ) বছর পূর্তি তথা সুবর্ণ জয়ন্তীতে এটিই আমার অন্তর নিংড়ানো প্রত্যাশা বা পবিত্র আশাবাদ।
লেখক পরিচিতি:
ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো
(মোনঘর এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক)
অধ্যক্ষ-আনন্দ বিহার, তবলছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং
অধ্যক্ষ-শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার, মিরপুর-১৩, ঢাকা।