এক টুকরো রুটি। নরম, সাদাসযতেœ হালকা কাগজে মোড়া রুটি নয়, যেন কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘনীভূত, মূর্ত।
এক টুকরো রুটি। নরম, সাদাÍসযতেœ হালকা কাগজে মোড়া রুটি নয়, যেন কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘনীভূত, মূর্ত।
করুণাময় ঈশ্বর যেদিন গাছে গাছে তৈরি রুটি ফলিয়ে রাখতেন, উপকথার সে সুখী পৃথিবীও মানুষ একদিন দেখেছিল। সত্যিই সেদিন রুটি গাছে ফলত। কিন্তু সে রুটি এমনই নরম, সাদা, কাগজে মোড়া নয়। সে রুটি এমনকি চাপাটির মতো কর্কশ, স্নিগ্ধ, মনোরম চন্দ্রটিও নয়। নাম তারÍগম, বার্লি, ওট, রাই কিংবা ধান।? আদিম পৃথিবীর ক্ষুধা মেটাতে ঈশ্বর বুনো ঘাসের হাত দিয়ে মুঠো মুঠো এ বস্তুই সেদিন চারদিকে ছড়িয়ে রেখেছিলেন।?রুটি তাই তৎকালে আশ্চর্য কতকগুলো ফসলমাত্র। এমন ফসল যা খেলে দেহে বল অটুট থাকেÍপৃথিবীকে যথার্থই রহস্যময় মনে হয়।? নরম, সাদা, সযতেœ হালকা কাগজে মোড়া আজকের এ রুটি সেদিন রেল ইঞ্জিন বা ঘরে বিদ্যুতের আলোর মতোই অভাবিত।
কোনো না কোনোভাবে শস্যে ক্ষুধা মেটানোর অভ্যাস মানুষের কমপক্ষে ১৫ হাজার বছরের। কিন্তু সে ফসলকে পাকিয়ে শুকিয়ে, গুঁড়িয়ে পুড়িয়ে রুটি তৈরির অভ্যাস আমাদের মাত্র পাঁচ হাজার বছরের। সভ্যতার সে আদি হেঁশেল মিনরÍনীল উপত্যকা। পিরামিডের উদর থেকে এমন খাবারের থালা বের হয়েছে, যেখানে বলতে গেলে আধুনিক রুটি তার আজকের চেহারায়ই দিব্য সেজেগুজে বসে আছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো এমনই এক প্রস্থ রুটি এখনো রয়েছে আমেরিকার এক মিউজিয়ামে। শুধু উপাদানে নয়, আকারেও তা রীতিমতো বিস্ময়কর। চৌকো, গোলাকার, মাছ, পাখি, পিরামিড, স্ফিঙ্কসÍরুটির সম্ভাব্য যত রকমের চেহারা হতে পারে ফারোর কারিগর সব তৈরি করে সাজিয়ে দিয়েছিল…তার মৃত প্রভুর জন্য, পরলোকে তার যেন ইচ্ছা পূরণে বিঘœ না ঘটে!
ফারো তখন কার্যত দ্বিতীয় ঈশ্বর। উপকথায় যে ঈশ্বর বিনামূল্যে রুটি বিতরণ করেন, তিনি মন্দিরে, ধ্যানে স্থান লাভ করেছেন। প্রাকৃতিক অন্নসত্রের দিন বিগত। রুটি এখন অর্জনসাপেক্ষ। তার একমাত্র প্রভু দেশের সম্রাট মহামান্য ফারাও। দেশের সমুদয় মানুষ তার, জমি তার, ফসল তার। যদিও অসংখ্য এ মানুষের পরিশ্রমেই মাঠের এ ঐশ্বর্য, যদিও অগণিত মানুষের হাত পুড়িয়েই অদ্যকার এ রুটি, তাহলেও রুটির মালিক একমাত্র তিনিই। অন্যদের তা অর্জন করে নিতে হবে। মিসরে তখন পারিশ্রমিক দেয়া হয় রুটিতে। দাস থেকে শুরু করে মাননীয় মন্ত্রী সবারই মাইনে তখন রুটি। কেউ বেশি পেয়ে থাকেন, কেউ কমÍএই যা!
ইউরোপে পুরনো খাদ্যশস্য ছিল আয়েকর্ন (ঊরহপড়ৎহ)। তারপর এল বার্লি, এমার ও গম। ক্ল্যাসিক্যাল ইউরোপ তখন প্রধানত বার্লি খেয়েই বলবান। কিন্তু গমের স্বাদ জিভে ঠেকামাত্র পুরনো অভ্যাস বাতিল হওয়ার উপক্রম হলো। গমের সন্ধানে গ্রিস, রোম, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ রাশিয়া পর্যন্ত ছুটে বেড়াতে হলো। প্রজার খাদ্য সমস্যা যদিও তখন বহুলাংশে রাজকর্তব্য, তবু রুটি তৈরি ছিল পরিবারের ঘরোয়া ব্যাপার। পাউরুটি যে উনুনে সেঁকা যেতে পারে পৃথিবীর কোনো গৃহকর্ত্রী সেটা খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের আগে চোখে দেখেনি। গম পেষাইয়ের ব্যবস্থা, হামানদিস্তা, চালুনিÍএসবও নতুন কোনো দেশে সওদা করতে গিয়ে একদিনে সব পাওয়া যায়নি। তবে পৃথিবীর গৃহিণীকুল শুনে গর্বিত হবেনÍযন্ত্রবিজ্ঞানের ইতিহাস বলে, রোটারি মিল থেকে আরো বহুবিধ কল আবিষ্কার হয়েছিল রান্নাঘরেই! ফলে স্বভাবতই ইউরোপে প্রথম প্রথম যে রুটি খেয়ে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নেচেছিল সে রুটিতে শুধু আধভাঙা গম নয়Íভাঙা পাথর, কাঁকর, পাথরকুচিও থাকত বিস্তর।
তবু সে প্রাচীন গৃহস্থের সংসারে একদিক থেকে ঝামেলা ছিল কম। পোড়া হোক, আধপোড়া হোকÍবিস্কুটের মতো শক্ত খটখটে সে রুটি (কেননা অন্যান্য প্রয়োজনীয় অনুপাতগুলো তখনো জানা যায়নি) বাড়িতে বসেই পাওয়া যেত। গম যখন পাওয়া যেত না সরকার তখন শস্য খয়রাত করত। রোমান ইতিহাসে সে দাতব্যের নাম ‘?কর্ন ডোল’। প্রজা যখনই অশান্ত, সরকার তখনই প্রয়োজনমতো গম বিলিয়ে দিতেন তাদের মধ্যে। কথায় বলে ‘ব্রেড আর গেম’Íরুটি আর অ্যাম্পিথিয়েটারের বীভৎস খেলা নিয়েই রোমানের জীবন।
কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় মোটামুটি স্থিতি আসার সঙ্গে সঙ্গে শহরে শহরে আবির্ভূত হলো বিশেষজ্ঞ রুটি কারিগরের দল। তার বেকারি বা রুটিওয়ালা। তাদের আবির্ভাবে সংসারী রান্নাঘরের দায়িত্ব থেকে বহুলাংশে ছুটি পেল বটে, কিন্তু সমাজে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হলো। রুটির জীবনে সে আর এক বিচিত্র কাহিনী!
ফ্রান্সের রানী ম্যারি আতোয়ানেত ছবি: ভার্সাই
যেহেতু রুটি ‘পরমব্রহ্ম’, তদ্ভিন্ন গতি নেই এবং যেহেতু ‘বেকার মহো দয়ই’ একমাত্র মানুষ যিনি সাধারণ খাদ্যটিকে পরম উপাদেয় বস্তুতে রূপান্তরের বিদ্যা অবগত আছেন, সুতরাং শুরু হলো তার যুগ। পৃথিবীতে কোনো রন্ধনশিল্পী কিংবা কোনো পাচক এর আগে সে ক্ষমতা কোনোদিন ভোগ করেনি। মধ্যযুগের জার্মানিতে একজন সাধারণ মানুষকে খুন করলে যে সাজা, তার চেয়ে তিন গুণ বেশি দ- একজন রুটি কারিগরকে মেরে ফেললে। জার্মানিতে তখন রুটিওয়ালারা সুসংগঠিত সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে অনেক ‘গিল্ড’ বা ইউনিয়ন। কারো দলের নাম ‘হোয়াইট’, কারো ‘ব্ল্যাক’, কারো ‘মিষ্টি’, কারো ‘টক’। যারা সাদা রুটি তৈরি করে তারা কালো গড়বে না, যারা টক রুটির কারিগর তারা মিষ্টি রুটিতে হাত দেবে না।
রুটি নিয়ে তখন বিন্যাসের অন্ত নেই। হেঁশেল বরাবরই কমবেশি গবেষণার জায়গা। এক মাংস হাজার রকমে সুস্বাদু করার চেষ্টা হয়েছে সেখানে। মাছ-সবজি নিয়েও নানা এলাহি কা-।
বাংলাদেশের ‘অন্নদামঙ্গল’ কিংবা ‘?মনসামঙ্গলে’র পাতা খুললে দেখা যাবে এক মাছেই কত দীর্ঘ ‘?মেনু’ আমাদের এ বাংলাদেশেই ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকরা বলেন, ‘?মাছ নয়, মাংস নয়, মানুষ সবচেয়ে বেশি মাথা খাটিয়েছে যে বস্তুটি রান্না করতে সে এই রুটি।’
কত রকমের রুটি হতে পারে, কী করে সেরা রুটি গড়া যেতে পারে তাই নিয়ে সেদিন শুধু যে কারিগরই ভেবেছে তাই নয়Íবিলাসীর অবসর বিনোদনেও তখন রুটি অন্যতম খেলা।
মধ্যযুগেই ফরাসি রাজপ্রাসাদের কারিগরদের প্রতিদিন কুড়ি ধরনের রুটি তৈরি করতে হতো। কোনোটি কেবল রাজভোগ্য, কোনোটি রানীপছন্দÍরাজকুমাররা খাবেন অন্য ধরনের, অতিথিরা, যাজকেরা, বয়স্যরা, ভৃত্যেরা প্রত্যেকে ভিন্ন ধরনের।
তবে টক-ঝাল-মিষ্টি লুচি, পরোটা অথবা চাপাটি যে যত রকমের রুটিই চোখে দেখে থাকুন, সেকালের ইউরোপ আজকের এ ধবধবে সাদা, নরম, রুটির মুখ দর্শনের সুযোগ পায়নি। এ রুটি নিতান্তই হাল আমলের ব্যাপার।? মোটামুটিভাবে বলা চলে তার আবির্ভাবকাল ১৮২০। ইউরোপে ভালো-মন্দ যত রুটি সবই কমবেশি কালচে, পোড়া বা আধপোড়া। স্বভাবতই আমাদের দেশে যেমন মিহি, মোটা, অতিমিহি; বাসমতী কিংবা কালিজিরা চালের এ রকমফেরের ওপর যেমন সামাজিক মর্যাদা ওঠানামা করে (আজ আর সম্ভবত তা করে না, কেননা কালগুণে চাল এখন কাঁড়া-আকাঁড়া প্রশ্নের বাইরে!), তেমনি সেদিনের ইউরোপে?আভিজাত্যের অন্যতম মানদ- রুটি। কার রুটি কতখানি পোড়া তার ওপরই নির্ভর করে সমাজে তিনি কোন পর্যায়ে। নিতান্ত গরিব যে তার পক্ষে কৃষ্ণকান্ত পোড়া রুটি ছাড়া নানা পন্থা; ধাপে ধাপে ক্রমে ছায়ামুক্ত হয়ে সে রুটি সমাজের শীর্ষে পৌঁছে অবশেষে হবে চাঁদ। অবশ্য আগেই বলা হয়েছে সে চাঁদ উনিশ শতকের আগে কখনো সম্পূর্ণ কলঙ্কমুক্ত নয়।
রুটি রুটি রুটি!
‘নট বাই ব্রেড অ্যালোন’ অবশ্যই,–কিন্তু মানুষেরই ইতিহাসে তবু রুটি যেন সর্বস্ব। নিওলিথিক মানুষ ভবঘুরে জীবনে দাঁড়ি টেনে দিয়ে কবে কৃষিকাজ শুরু করেছিলÍসভ্যতা তারপর ধাপে ধাপে এগিয়ে এসেছে অনেকদূর; রুটির তবু ছুটি নেই। এখনো তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি, আইন, আর্তনাদ, আনন্দোৎসব। ইতিহাসে রুটি এক আশ্চর্য অস্তিত্ব।
সেবার বৃষ্টি হলো না।?ফসল মারা পড়ল। সবুজ খেত খড় হয়ে গেল।
পুকুর বিল শুকিয়ে চৌচির। ধু ধু মাটিতে আগুন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। পোড়ামাটিতে থেকে থেকে কীসের যেন ছায়া পড়ে। মনে হয় কোথাও যেন শকুন উড়ছে। এ দৃশ্য থেকে থেকে এখানে ওখানে আজও দেখা যায়। জোয়ান মানুষগুলো দেখতে দেখতে শুকিয়ে পোড়াকাঠ হয়ে আসে। সে ছায়াবাহিনী চিরকালের আশ্রয় ছেড়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথ ধরে এগিয়ে চলে। পথের দুধারে ফুলের মতো শিশুরা টুপটাপ ঝরে পড়ে। তারপর ক্রমে অন্যরা। দেশ শ্মশান। কেননা আকাল এসেছে, দেশে রুটি নেই।
দুর্ভিক্ষ রুটির মতোই মানুষের কাহিনীতে পুরনো সহচর। পিরামিডে পাওয়া পাঁচ হাজার বছরের পুরনো রুটির কথা বলা হয়েছে। একই নীল উপত্যকায় একটি কবর ফলকের পাঠোদ্ধার করে পরবর্তীকালের মানুষ জেনেছেÍসে স্বর্গেও ক্ষুধা ছিল। আব্রাহামের দুই হাজার বছর আগেও মানুষ না খেয়ে মারা যেত। ভারতেও দুর্ভিক্ষ আমাদের পুরনো সহচর। ঋগ্বেদের প্রার্থনায় মানুষ দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছে। রামায়ণ, নিরুক্ত, জাতক, অর্থশাস্ত্রেও একই প্রার্থনা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে! রুটির সমস্যা অতএব নতুন কিছু নয়।
ইউরোপে প্রথম যে দুর্ভিক্ষের প্রামাণ্য কাহিনী মানুষের গোচরে এসেছে তার তারিখ খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৬ অব্দ। ক্ষুধার্ত রোমানরা সেবার রুটি না পেয়ে উন্মত্তের মতো হাজারে হাজারে টাইবারের জলে আত্মবিসর্জন করেছিল!
দুর্ভিক্ষ তৎকালের পৃথিবীতে বলতে গেলে প্রায় নিত্যকার ঘটনা। ১০০০ থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দÍএই ৮৫০ বছরে ইউরোপে বড় রকমের দুর্ভিক্ষ হয়েছে কমপক্ষে ৪৫০ বার। ১৮৪৬-৫১ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ডে আলু দুর্ভিক্ষেই মারা গিয়েছিল ১০ লাখ মানুষ। আর দেশান্তরী হয়েছিল ?১৫ লাখ। সুতরাং ঐতিহাসিক সেসব রুটি দুর্ভিক্ষগুলোর ফলাফল অনুমেয়।
ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইতিহাস বলে ইংরেজরাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এ দেশে দুর্ভিক্ষ আসত গড়ে প্রতি ৫০ বছরে একবার। একাদশ-সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এমনই ১৪টি দুর্ভিক্ষের কাহিনী আছে ভারতের ইতিহাসে। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ইংরেজ আমলে তার গতি যেন আরো দ্রুত। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দিয়ে শুরু, শেষ পঞ্চাশের মন্বন্তরেÍসুতরাং সে কাহিনী আমরা মোটামুটি জানি। কিন্তু বিশেষভাবে যে খবরটা শোনা দরকার সেটা হচ্ছে এই যে বাংলার এ দুই দুর্ভিক্ষই ভারতে ইংরেজ রাজত্বের একমাত্র খবর নয়। ১৭৬৫ অর্থাৎ দেওয়ানির দিন থেকে ১৮৮৫ মহারানীর রাজত্বের সূচনা পর্যন্ত আরো ১২ বার মন্বন্তর উঁকি দিয়েছে গোধুম আর ধানের অন্যতম প্রাচীনা জননী এ দেশের মাটিতে। তদুপরি চার-চারবার ‘স্কারসিটি’ বা প্রবল খাদ্যাভাব। পরবর্তীকালে ১৮৬০-১৯০৮ পর্যন্ত ৪৯ বছর রাজত্বে ২০ বছরই ছিল এমনই ‘স্কারসিটি’ বা আকালের বছর। দেশে খাবার নেই। ভাত, চাপাটি, রুটি কিছুই নেই। ঝাঁকে ঝাঁকে তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। কেননা চাল অথবা গম, যব বা বার্লি যে নামেই মানুষ চেনে তাকে, নিষ্ঠুর রুটির কোনো বিকল্প নেই!
দুর্ভিক্ষ সেবার অনিবার্য ছিল। কেননা প্রাচীন পৃথিবীতে দ্রুতযান ছিল না, যোগাযোগ ছিল না। সংগঠনও সুবিন্যস্ত ছিল এমন বলা চলে না। ফলে কি রোমে, কি দিল্লিতে দুর্ভিক্ষ যখন হানা দিত তখন ধনী-নির্ধন বাছাই হতো না। মহম্মদ তুঘলদের মতো সম্রাটও (১৩৪৩ খ্রি.) হঠাৎ শুনতেন প্রাসাদে খাবার নেই। সেকালের দুর্ভিক্ষ সত্যিই ভিক্ষাও পাওয়া যায় না, এমন দুর্দিন। ‘এক সঙ্গে ভাগ করে খেতে হবে অন্নপান’ সেদিনের পক্ষে যথার্থই অর্থপূর্ণ অভিশাপ। কিন্তু পরবর্তীকালে সব দুর্ভিক্ষে এই বাণী সবসময় আপন মাহাত্ম্য রক্ষা করতে সমর্থ হয়নি। কেননা রুটি শুধু মানুষের ভা-ারে শ্রেষ্ঠতম ঐশ্বর্য নয়এই রুটি ঘিরেই মানুষের অন্যতম হীন ষড়যন্ত্রগুলোও। ছিয়াত্তর বা পঞ্চাশের মন্বন্তরে মানুষের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। আধুনিককালের অনেক আকালের পেছনেও একই ইতিহাস লুকানো। দুর্ভিক্ষ একালে নানা দিক থেকেই এক ক্রূর চক্রান্ত। যেন কোনো নিপুণ সেনানায়কের পরিকল্পনা। কীভাবে, কখন কোন দিক থেকে সে মৃত্যুদূত সামনে এসে দাঁড়াবে অনেক সময়ই বেচারা শত্রুপক্ষ তা হদিস করে উঠতে পারে না। কখনো অর্থাভাব, কখনো কর্মাভাব, কখনো শুধু এক জায়গার ফসল অন্য জায়গায় পৌঁছার উদ্যমের অভাব, কখনো বা হৃদয়হীন অপচয় কিংবা দেশান্তরে পাচারÍদুর্ভিক্ষের জন্য একালে অনেক রন্ধ্র। ফলে আধুনিককালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ভিক্ষ আর একসঙ্গে সবার জীবনে আসে না। ১৮৯১ সালে বাংলায় তীব্র এক খাদ্যাভাবের দিনে এখানকার গভর্নর লিখেছিলেনÍখাদ্যের অভাব এমন কথা বলতে পারি না। দেশে খাদ্য আছে। এখনো প্রতিদিন এক আনা ব্যয় করলে যে কেউ অনায়াসে এখানে খেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই অধিকাংশ মানুষের হাতে সেই ‘আনাটাই’ নেই। তার অব্যবহিত পরে তারা এক দুর্ভিক্ষ উপলক্ষে উদ্বিগ্ন কর্তৃপক্ষ শিক্ষা বিভাগের কাছে জানতে চেয়েছিলেনএত মানুষ মারা গেল, স্কুলে ছাত্র আসছে কি? উত্তর হয়েছিলহ্যাঁ, আসছে। শুধু পুরনোরা নয়এই দুর্ভিক্ষে গ্রামাঞ্চলে যেন নতুন একটি সচ্ছল শ্রেণী দেখা দিয়েছে, তারাও ছেলেদের স্কুলে পাঠাচ্ছে!
লালসার একই কাহিনী ইউরোপেও। আজ ইউরোপের যেকোনো দেশে খাদ্য যেকোনো সরকারের প্রথম মনোযোগের বিষয়। খাদ্যের গুণ পরিমাণ বিষয়ে সেখানে বিন্দুমাত্র শৈথিল্যের সুযোগ নেই। এই দায়িত্ববোধ একদিনে জন্মায়নি। আজকের শান্তশিষ্ট আইনগত-প্রাণ রুটি কারিগর তার জীবনেও সেই যথেচ্ছাচারের দিন দেখেছে। তবে একালে নয়, কিছু আগে।
ক্ষুধার্তের কাছে ঈশ্বর রুটি হয়ে আবির্ভূত হন। সুতরাং, আদিতে ‘বেকার’ যখন ক্রমে দ্বিতীয় ঈশ্বরে পরিণত হলেন তখন তার বাসনা হলো ব্যবসায়িক ভক্তের সঙ্গে থেকে থেকেই লুকোচুরি খেলতে। অভিধানে সে খেলার নামই স্পেকুলেশন। গমের দাম দু পেনি বেড়ে গেছে, সুতরাং রুটির দামও বাড়লÍবলেই নিত্যকার রুটিটির চেহারা পাল্টে দেয়া হলো। সেই ১২০২ খ্রিস্টাব্দের কাহিনী! প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
যতদূর মনে পড়ছে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তখন রাজা জন। তিনি নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হলেন। ঞযব অংংরুব ড়ভ ইৎবধফ চালু হলো। প্রজার মুখের অন্ন রক্ষার্থে সেই প্রথম রাজকীয় উদ্যম। স্থির হলো রুটি নিয়ে খেলা চলবে না। রুটি কিসে তৈরি হবে, কত দাম হবে সব নির্দিষ্ট করে দিলেন তিনি। ? ক’বছর পরে ১২৬৬ সালে তৃতীয় হেনরি প্রবর্তন করলেন দ্বিতীয় নিয়ম। তিনি বললেন কোনো অবস্থাতেই ‘বেকার’ বা কারিগর শতকরা ১৩ ভাগের বেশি লাভ রাখতে পারবে না। তিনি আরো বললেন, এমন ব্যবস্থা চাই যে প্রজারা ঘরে বসে রুটি পায়। রাজ-নির্দেশে প্রতিদিন সকালে রুটিওয়ালি দরজায় এসে কড়া নাড়ত। বারোটা রুটির দাম দিয়ে সে দোকান থেকে তেরোটা রুটি পেত। সেই ফাউখানাই তার ফেরি করার মজুরি! এ আইন পাঁচশ বছর ধরে বহাল ছিল! এবং পরবর্তীকালের ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘পুওর ল’ বা দরিদ্রজন রক্ষাবিষয়ক আইন সেই সূত্র ধরেই জাত। ইংল্যান্ডের রাজশক্তি রুটির ক্ষমতা বিষয়ে বরাবর অতিশয় সতর্ক। আজ আমরা যে পাউন্ড, হাফ-পাউন্ড ওজনে রুটি কিনিÍরুটিতে এ ওজন তাদেরই দান। পাছে ধূর্ত বেকার শুধু আকার বাড়িয়ে প্রজা ঠকায় সে কারণে ওরাই বলে দিয়েছিলেনÍঅতঃপর রুটি বিক্রি হবেÍওজন মেপে, শুধু আকার দেখিয়ে নয়! সে আদেশ বহাল আছেÍ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ?
‘গিভ আস দিস ডে আওয়ার ডেইলি ব্রেড।’ প্রতিদিন আজও এই প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয় কোটি কোটি মানুষের দিন। জাপানি প্রবাদ বলেÍভাত চেরি ফুলের চেয়েও সুন্দর! ভারতীয় চাষী বলেন বিচিত্র এ সংসার। গরিব এখানে রুটি খোঁজে, ধনীÍক্ষুধা! প্রতি দেশে প্রায় প্রত্যেক সমাজে এমন অগুনতি প্রবাদ ভাত অথবা রুটি নিয়ে। এক একটি উক্তি যেন এক একটি তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। সুতরাং যে নরপতি প্রজার রুটি বিষয়ে উদাসীন তিনি সত্যিই দুর্ভাগা। কেননা ক্রূর রুটি, নিষ্ঠুর রুটি শুধু যে দুর্ভিক্ষের বেশে গরিবের ঘরেই হানা দিয়ে ফিরতে পারে তা-ই নয়, কখনো কখনো সুদৃঢ?, সুরক্ষিত প্রাসাদ কন্দরেও ত্রাসের সঞ্চার করে। রুটি তখন বিপরীত দিক থেকে অমঙ্গলের বার্তাবহ।
যথা ১৮৫৭-এর ভারত। তখনো বিদ্রোহ শুরু হয়নি। হঠাৎ দেখা গেল সমগ্র উত্তর ভারতের গ্রামে গ্রামে নিঃশব্দে হাত ফিরি হচ্ছে হিন্দুস্তানি গৃহস্থের প্রিয় খাদ্যÍচাপাটি। ইংরেজ রাজত্ব। দেখতে দেখতে চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। প্রবল সাহেবরা তথ্যতাল্লাশি করে জানালেনÍনা, কিছু নয়। মথুরা থেকে থর্নহিল লিখেছিলেনÍন’দিনের সেই বিস্ময় নিজে নিজেই মিলিয়ে গেছে। শুধু কেউ কেউ বলেছে, এ শতকের শেষ দিকে ভেলোরে যে বিদ্রোহ হয় তার আগেও নাকি এমনি চাপাটি ছড়ানো হয়েছিল!
তবু ব্যাপারটাকে কেউ তেমন গুরুত্ব দিলেন না। কেউ বললেনÍযারা এই চাপাটি ছড়াচ্ছে তারা জানে কোম্পানি থেকেই এগুলো বিতরণের জন্য পাঠানো হয়েছে। কেউ বললেন, দেশে কলেরা বসন্ত লেগেছে। অনেকের ধারণা তাকে ঠেকানোর জন্যেই এ মন্ত্রপূত রুটি গাঁয়ে গাঁয়ে ছড়ানো হচ্ছে। এই চাপাটি আসলে ‘চালাওয়া’Íরোগের প্রতিষেধক। অনেকের মতÍচাপাটি আগতপ্রায় কোনো বিপর্যয়ের সংকেত। সীতারাম বাবা নামে একজন সাক্ষ্য দিয়েছিলেনÍশুধু চাপাটি নয়, চাপাটির মধ্যে পদ্মবীজও ছিল। এবং তা ছড়ানো হয়েছিল বিদ্রোহের ইঙ্গিত হিসেবে!
পরবর্তীকালে এই চাপাটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা গবেষণা হয়ে গেছে। গবেষকরা কেউই চাপাটিকে ’৫৭-এর মহা বিদ্রোহে বিশেষ কোনো ভূমিকা। দিতে চান না। কিন্তু তবু আজও কোটি মানুষের মনে বিদ্রোহের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেদিনের সেই চাপাটি! কেননা রুটি শুধু খাদ্য নয়, গ্রিক ইহুদি মিসরীয় ব্যাবিলনিয়ান আর্যÍবহু সভ্যতায় রুটি ধর্মের সঙ্গে পবিত্র সম্পর্কে যুক্ত। তার মন্ত্র সাধনেও ক্ষমতা আছে বৈকি! অন্তত একবার ইউরোপ তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে।
Íওরা কী চায়?
Íরুটি।
Íরুটি নেই? বেশ তো লেট দেম ইট কেক! বলেছিলেন নাকি ফরাসি রানী মেরি অ্যাতোনেত। এ বাক্যের পরিণতি আজ সবার জানা। ?
রাজা ষোড়শ লুই সম্ভবত তার প্রিয় রানীর চেয়ে বিজ্ঞতর ছিলেন না। এমন যে হিন্দুস্তানি সুলতান তিনিও দুর্ভিক্ষের দিনে দিল্লিকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথ প্রজার উদর-চিন্তায় নির্দ্বিধায় রাজকীয় তূণ থেকে একের পর এক তীক্ষ্ণ আইনের শর তুলে নিয়েছিলেন (১৫৮৬)। পরবর্তীকালের প্রথম পুওর লর (১৬০১) পেছনে তার সেই প্রজারক্ষী আইন অনেকখানি। কিন্তু লুই সে পথে গেলেন না। তিনি সংক্ষেপে কার্যোদ্ধারে ব্রতী হলেন। অনুগত অভিজাত বয়স্যদের নিয়ে তিনি এক সভা গড়লেন। তাদের ওপর অর্পিত হলো রাজধানীর রুটির দায়িত্ব। রাত্রি ভোরেই প্রজারা জানলেনÍতারা অতঃপর আরো লোভের শিকার হলেন। লুইয়ের অ্যাসোসিয়েশনের নাম দিলেন তারাÍদ্য ফেমিন এগ্রিমেন্ট। কেননা এ সভা অভাব মেটানোর পরিবর্তে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতেই যেন অধিকতর তৎপর। রাজধানীর মুখে রুটি নিয়ে রকমারি খেলায় মত্ত হয়েছেন সেই স্পেকুলেটর দল। তারা আর সব ভুলে শুধু নিজেদের রুটিতে আরো, আরো চিজ, মাখানোর কথাই ভাবছেন। এসব ১৭৬৫ সালের কথা। প্রজার হয়ে পার্লামেন্টে প্রশ্ন তুললেন বিউমন্তর প্রভোস্ট। ২২ বছরের জন্য বাস্তিলের কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হলো তাকে। দুঃসাহসী কন্ট্রোলার জেনারেল টার্গট তবু একবার শেষরক্ষার চেষ্টা করলেন। কমিটির হাত থেকে রুটির ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার কেড়ে নিয়ে আবার তিনি বাজারকে স্বাধীন করে দিলেন। ফলে দুর্ভিক্ষের কারিগররা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। মরিয়া হয়ে তারা দাঙ্গায় নামলেন। রুটির ব্যবসার অধিকার নিয়ে এই দাঙ্গার নামই ফরাসি ইতিহাসেÍফ্লাওয়ার ওয়ার বা ময়দাযুদ্ধ।
রাজপ্রাসাদÍতখনো রুটির মহিমা জানে না। ফলে তথাকথিত এই যুদ্ধে ক্রূর রাজকীয় ব্যবসায়ী দল তথা পুরনো সেই কমিটিরই জয় হলো। তারা আবার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত হলেন। কিন্তু সে মাত্র কিছুদিনের জন্যে।
দেখতে দেখতে সামনে এল ১৭৮৯ সালের রক্তাক্ত গ্রীষ্ম এবং সেই ভয়ংকর দিন এল এই রুটির চাকায় ঘর্ঘর রব তুলেইÍক্ষুধার রথে সওয়ার হয়ে। অক্টোবরের ৫ তারিখে বাস্তিলের পথে নামল ক্ষুধার্ত, নারী শোভাযাত্রা। সে শোভাযাত্রাই বিখ্যাত ‘ব্রেড মার্চ অব দ্য উইমেন’।
সুরেলা গলার দেশের রানী সেদিনই নাকি বলেছিলেনÍছঁরষং সধহমবহঃ ফব ষধ নৎরড়পযবÍলেট দেম ইট কেক!Íওরা কেক খেলেই পারে!
তারই উত্তরÍসেদিনের বাস্তিলÍফরাসি বিপ্লব।
বিষয় যেখানে রুটি, ইতিহাস সেখানে বরাবরই এমনই করুণাহীনÍঅবুঝ।
[প্রবন্ধটি শ্রীপান্থের লেখা ভি. এম. লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত শ্রীপান্থের নানারকম বই থেকে নেয়া। শিরোনাম পরিবর্তিত।] শ্রীপান্থ: লেখক, সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক