ঠাকুরগাওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলা জুড়ে শুরু হয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘ভাদর কাটানি উৎসব’। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনাকালেও গ্রামের মানুষ এখনও ভোলেনি যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই উৎসবের কথা। পহেলা ভাদ্র থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবে নববধূরা বাবার বাড়ি নাইওর যাওয়া শুরু করেছেন। আধুনিকতার যুগে শহরাঞ্চলে এর প্রভাব না থাকলেও গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে উৎসবটি অধিক পরিচিত। বাংলা চলতি মাসের প্রথম দিন থেকে কমপক্ষে ১৫ দিন পর্যন্ত স্বামীর মঙ্গল কামনায় নতুন বধূরা তার স্বামীর মুখ দর্শন করবেন না। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই উৎসবের কোনও ব্যাখা বা যুক্তি না থাকলেও বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষের এটি আদি প্রথা। যা বাপ-দাদারা পালন করতো। উপজেলার রাতোর ইউনিয়নের ধামেরহাট গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব তসলিম উদ্দিন জানান, বিয়ের এক বছরের মাথায় ভাদ্র মাসের শুরুতেই মায়ের নির্দেশে আমার স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে যায়। এটা চিরাচরিত নিয়ম বলে আমার বলার কিছুই ছিল না। প্রায় ১৫-২০ দিন পর সে বাড়িতে আসে। এছাড়াও গ্রামীণ ঐতিহ্য হিসেবে ভাদ্র মাসে মামির হাতে ভাত খেতে হয়। এখনও ভাগ্নেরা মামার বাড়ি গিয়ে মামির হাতে ভাত খায়। কারণ ভাদ্র মাসে নানা ধরনের অসুখ বিসুখ লেগে থাকে। তাই বড়দের মতে, মামির হাতে ভাত খেলে বাকি ১১ মাস ভালো থাকা যায়। একই এলাকার শশী মোহন রায়(৭৮) জানান, উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও’সহ ভারতের মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি এলাকার বাঙালি সমাজেও এই প্রথা চালু আছে। তিনি বলেন, এই জন্য ভাদ্র মাসে বিয়ের আয়োজন হয় না বললেই চলে। গ্রামীণ প্রথা অনুযায়ী যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে পালিত হয়ে আসছে এই ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব। নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে পক্ষ শ্রাবণ মাসের সাত দিন বাকি থাকতেই মেয়েকে বাবার বাড়ি নিয়ে আসতে ছেলের বাড়িতে আম, কাঁঠাল, কলা ও তাল’সহ মিষ্টি (জিলাপি), পায়েস (ক্ষির) নিয়ে যায়। সেই অনুষ্ঠানে ছেলে পক্ষ তাদের সাধ্যমত আপ্যায়ন করান। বাচোর ইউনিয়নের কাতিহার স্কুলের শিক্ষক ছবি কান্ত রায় (৬৫) জানান, এটি কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। তবে প্রথাটি দীর্ঘদিন ধরে সমাজে চলে আসছে। এক সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই উৎসব ঘটা করে পালন করতো। আর এই রেওয়াজ বা রীতি বংশানুক্রমে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে। এক পর্যায়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায় ‘ভাদর কাটানি উৎসব’।