মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ০৫:৩৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::

করোনা মহামারি কালেও কমেনি অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১

করোনা মহামারি প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সব দেশই বিভিন্ন মেয়াদে বারবার সীমান্ত বন্ধ করেছে। চলাচলে কড়াকড়ি বজায় ছিল প্রায় পুরোটা সময় ধরে। তবে এর মধ্যেও থেমে ছিল না সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসনের প্রয়াস। মহামারী পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছে অনেক বাংলাদেশী। অনেকে ধরাও পড়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, গত দেড় বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে আটক হয়েছে অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশী। অন্যদিকে জার্মানিভিত্তিক তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) সাগরপথে শুধু ইতালিতে প্রবেশের চেষ্টা চালাতে গিয়েই আটক হয়েছে ২ হাজার ৬০৮ জন বাংলাদেশী।
সর্বশেষ গত ২৪ জুন ভূমধ্যসাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় ৩৬৭ জনকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ৩৬৪ জনই বাংলাদেশী। এর আগে একইভাবে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা চালানোর সময় গত ১০ জুন ১৬৪ জন, ২৭ ও ২৮ মে ২৪৩ এবং ১৮ মে ৩৬ জন বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়। মে মাসে আলজেরিয়ার সীমান্তবর্তী মরুভূমি থেকে অপহরণকারীদের কবল থেকে ৮৬ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়।
সাগরপথকে ধরা হয় অবৈধ অভিবাসনের সবচেয়ে বিপজ্জনক পথ হিসেবে। পদে পদে মৃত্যুভয়। সাগরপথে পাড়ি দেয়ার আগেই আন্তর্জাতিক অপহরণকারী চক্রের কবলে পড়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারানো, এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কাও অনেক। আবার ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিতে অভিবাসনেচ্ছুদের গাদাগাদি করে তুলে দেয়া হয় ছোট ছোট নৌকায়। প্রতিনিয়তই সাগরে এসব নৌকা উল্টে গিয়ে প্রচুর মানুষের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। আবার বিপজ্জনক এ পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্য দেশে পৌঁছলেও রয়েছে ধরা পড়ে জেল-জরিমানার ভয়। যদিও এসবের কোনো কিছুরই ভয় থামাতে পারছে না ভয়ংকর এ যাত্রাকে।
অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে যেসব বাংলাদেশী আটক হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছর। জনপ্রতি খরচ পড়ে ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা। ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাগর পাড়ি দেয়ার আগে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে যেতে ভারত-শ্রীলংকা-লিবিয়া, দুবাই-জর্ডান-লিবিয়া ও দুবাই-তুরস্ক-লিবিয়া এ তিনটি রুটকে বেছে নেয় মানব পাচারকারীরা।
ইউরোপ প্রবেশের রুট হিসেবে বর্তমানে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একাধিক মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেকেই ওই সব দেশেও আটক হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত লিবিয়া, তিউনিশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাচারের শিকার ৩ হাজার ৭০০ জনকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। দেশে দেশে লকডাউন ও সীমান্ত পাড়ি দেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বা নানা মাত্রায় কড়াকড়ি থাকলেও তা আটকাতে পারছে না মানব পাচারকারীদের। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অবৈধ প্রবেশের চেষ্টা চালানো মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় অংশ যায় লিবিয়া হয়ে। এসব অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে সামনের সারিতেই রয়েছে বাংলাদেশীরা। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারানো বাংলাদেশীর সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে ইউএনএইচসিআরকেও। এরই মধ্যে সংস্থাটি এ নিয়ে বারবার সতর্কও করেছে।
ইউএনএইচসিআরের স¤প্রতি প্রকাশিত পরিচালন তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৬০ জন বাংলাদেশীকে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করেছে সংস্থাটি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি নাগরিক উদ্ধার হয়েছে তিউনিশিয়ার। ১৪ হাজার ৬৪৯ জন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে আলজেরিয়া ও মরক্কোর নাগরিকরা। এ সময়ের মধ্যে এ দুই দেশের নাগরিক উদ্ধার হয়েছে যথাক্রমে ৯ হাজার ৪৬৬ ও ৫ হাজার ৩৯৯ জন। সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও। কমিটির গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনায় বলা হয়, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনায় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বৈঠকে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ গমন রোধকল্পে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ক নিয়ে যৌথ কমিটি করে দায়ী সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি আইন অনুযায়ী যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার সুপারিশ উঠে আসে। একই বৈঠকে অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফেরত নিয়ে আসার পর রিমান্ডে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
বৈঠকে এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি বলেন, অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়া বন্ধে মুখ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ না থাকলেও অভিবাসীদের দায়দায়িত্ব প্রথমেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। তাই সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ গমন রোধকল্পে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথ কমিটি করে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর লাইসেন্স বাতিলের পাশাপশি আইন অনুযায়ী যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফেরত এনে রিমান্ডে নিয়ে তথ্য সংগ্রহপূর্বক তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন।
এ সময় কমিটির আরেক সদস্য গোলাম ফারুক খন্দ. প্রিন্স বলেন, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ গমন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষ মারা যাচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার শিকর হচ্ছে। ফলে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। জার্মানিভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী সংস্থা স্ট্যাটিস্টা প্রকাশিত তথ্য বলছে, চলতি বছরে প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) সমুদ্রপথে অবৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশ করে বাংলাদেশী পরিচয়ে আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধিত হয়েছে ২ হাজার ৬০৮ জন। এ সংখ্যা ছয় মাসে মোট আত্মসমর্পণকারীর ২১ শতাংশ। ইতালিতে ছয় মাসে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছে তিউনিশিয়ার নাগরিকরা। ২ হাজার ১১৩ জন তিউনিশিয়ার নাগরিক ইতালিতে প্রবেশ করেছে, যা মোট সংখ্যার ১৪ শতাংশ। অভিবাসনপ্রত্যাশীর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আইভরি কোস্ট। দেশটির মোট ১ হাজার ৪১০ নাগরিক ইতালিতে পৌঁছে নিবন্ধন করেছে। এছাড়া ইরিত্রিয়া থেকে গিয়েছে ৯৭১ জন, মিসর থেকে ৯৫৮, গিনির ৯৪৫, সুদানের ৯০৫, মরক্কোর ৬২৩, মালির ৫৬৮ ও আলজেরিয়া থেকে ৪৫৬ জন নাগরিক ইতালিতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে বছরের প্রথম ছয় মাসে।
গত বছর লিবিয়ার সমুদ্র উপকূলে অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশী অনেক বাংলাদেশীর সলিলসমাধি হয়। সেখান থেকে ৪২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে দেশে ফেরত আনা হয়, যার মধ্যে ২৮ জন সিলেটের অধিবাসী। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বেশকিছু ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে থেমে নেই সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশযাত্রা।
জানা গেছে, সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ গমন ঠেকাতে গত ১৪ জুলাই লিবিয়া তিউনিশিয়ায় উদ্ধারকৃত বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রত্যাবাসন এবং ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয় অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ শিরোনামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছাড়াও ইতালি, লিবিয়া, স্পেন প্রভৃতি দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরাও অংশগ্রহণ করেন। সভায় সমুদ্রপথে অবৈধ উপায়ে বিদেশযাত্রা রোধে বেশকিছু সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। সেসবের মধ্যে রয়েছে দুবাই থেকে বেনগাজি পর্যন্ত বাংলাদেশী নাগরিকরা যাতে সহজে যেতে না পারে সে ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। ট্রাভেল এজেন্টদের বিষয়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা এবং সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আরো জোরালো ভূমিকা রাখা। বিদ্যমান আইনকানুন ও বিধিতে সময়োপযোগী পর্যাপ্ত বিধান সংযোজন করা। মানব পাচারে জড়িত অপরাধীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, করোনাকালে অবৈধ পথে বিদেশ গমনের প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। খুব দ্রুতই একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এ ব্যাপরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, এভাবে মানব পাচারের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ প্রবণতা বন্ধে পাচারকারী ও পাচার হওয়া ব্যক্তিদের দেশে এনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, যারা অবৈধভাবে বিদেশ যাচ্ছে তাদের ও পরিবারের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com