ড.মুহাম্মদ আবদুল বারী
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও ওয়ার্ল্ড মিটার মিটারের জরিপ থেকে আমরা জানতে পারি করোনাভাইরাস মহামারীতে অনেক মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুর শিকার হয়েছে ।এ ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চায়নার উহান প্রদেশ। সেখানে ২০১৯ সালের শেষের দিকে এর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে । যদিও এর উপকেন্দ্র এখন ইউরোপ তবুও আশঙ্কা করা যাচ্ছে যে, এশিয়ান দেশগুলোর উপর দিয়েও এ ঝড় বয়ে যাবে।
বাস্তবতা হচ্ছে,করোনাভাইরাস মানুষের সামাজিক অবস্থানের কোনো তোয়াক্কা করে না। করোনাভাইরাস প্রাসাদে বসবাসকারী বিত্তশালী এবং বস্তিবাসী দরিদ্র কারো সাথে কোন বৈষম্য করে না। এ মহামারী শুধু বিশ্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেই হুমকীর মুখে ফেলেনি,অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে গোটা দুনিয়ার মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে। এটি পৃথিবীর সব মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারা বদলে দিয়েছে । বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, মেডিকেল এক্সপার্ট এবং বিত্তশালী ব্যবসায়ী সবাই এই ভাইরাসের মহামারী সামলাতে ব্যর্থনা পেরে আতঙ্কিত । ভাইরাস ছড়ানো বন্ধে প্রচেষ্টা হিসাবে অনেক দেশই তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে ।
বিশেষজ্ঞরা শুধুমাত্র ধারণাই দিতে পারছেন, কিন্তু কেউই সত্যিকার অর্থে বলতে পারছেন না কবে এই মহামারী শেষ হবে এবং কি কি ক্ষতচিহ্ন রেখে যাবে। আমরা বিজ্ঞান এবং টেকনোলজির দিক দিয়ে অনেক উন্নত হলেও ভাইরাসের মত একটা ক্ষুদ্র জিনিস বুঝিয়ে দিলো আসলে আমরা কতটা দুর্বল ।
কার্যকরীভাবে মহামারী নিয়ন্ত্রণ
এর আগেও মানুষ অনেক মহামারীর মুখোমুখি হয়েছে, তা অতিক্রমও করেছে । বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিবেশে যেসব দেশের কাছে বেশি অর্থ সম্পদ ও সামর্থ আছে, তারা যেসব দেশের পক্ষে সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সঙ্কট উত্তরণে সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এরকম একটি মহামারী মানুষের মনে অবরুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে । কিন্তু আতঙ্ক ও ভয় এর থেকেও বেশি ক্ষতিকর । তা নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য উপর থেকে সবকিছু সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নাগরিকদেরকে বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী চলতে হবে। স্বার্থপরের মত ‘আমি আগে আমিই সব ‘ এমন মনোভাব অন্যের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করবে না । এ সময় আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে । ” সবাই এ দুর্যোগে একসাথে” এ তত্ত্বে বিশ্বাসী হতে হবে । এই পরস্পর নির্ভরশীলতার দুনিয়ায় আমরা হয় একসাথে ডুববো নয় একসাথে ভাসবো।
সাধারণ জ্ঞান থেকে পদক্ষেপ নিন
আমরা অবশ্যই ভয় পাবো না। “জানবো -ভাববো-করব” এটাই হচ্ছে সাধারণ জ্ঞানের নীতি। আমরা এই ভাইরাস মহামারী সম্পর্কে তথ্য মেডিক্যাল এক্সপার্ট এবং অন্যান্য নির্ভরযোগ্য স্থান থেকে প্রায় সবাই জানতে পারি। বিনোদনের জন্য দেওয়া ভুল তথ্যগুলো আমাদেরকে ভুল সিদ্ধান্তে পৌছে দিতে পারে এবং তা আরো মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমাদেরকে সাধারণ গাইডলাইনগুলো অনুসরণকরতে হবে যেমন হাত ধোয়া ,শারীরিক দূরত্ব , ভিড় এড়িয়ে চলা – এগুলোই সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ।
এসব নতুন কিছুই নয় । আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম চৌদ্দশ বছর আগেই কোন মহামারী এলে স্বাস্থ্যবিধি এবং কোয়ারেন্টাইন এর বিধান দিয়েছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন,”যদি কোথাও প্লেগের কথা শুনো তবে সেখানে যেওনা। আর এটা যদি এমন কোথাও হয় যেখানে তুমি থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হইও না।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) এই পদক্ষেপটি বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই নেওয়া হয়েছে।
যাদের সেল্ফ আইসোলেশন প্রয়োজন তিনি এবং তাদের পরিবারও যেন এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ না করে । আমাদের পরিবারের এবং চারপাশের মানুষদের বাঁচাতে যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তার সবই নিতে হবে। যেকোনো বুদ্ধিমানেই এই অতিরিক্ত সময়টাকে বাসায় কোন একটা ভালো কাজে লাগাবে । হতে পারে সেটা মেডিটেশন ( আত্মউন্নয়নের জন্য গভীর চিন্তা ও গবেষণা) কিংবা বই পড়া। বাসায় অতিরিক্ত সময়টুকুও দুর্যোগের আড়ালে আলো হিসেবে দেখা যেতে পারে।
অন্যের মঙ্গলের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন
আমাদেরকে অন্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষভাবে আমাদের পরিবার পরিজন প্রতিবেশী কিংবা বন্ধুদের জন্যে। এই কাজটি করতে হবে খুবই বিচক্ষণতার সাথে ও সৃজনশীল উপায়ে। যেসব অভিভাবক সব সময় ব্যস্ত থাকেন তারা এই সময়টিকে তার বাচ্চাদের জন্য ব্যয় করতে পারেন । যেসব মানুষরা ব্যস্ততার কারণে প্রতিবেশীদের সময় দিতে পারেন না, তারাও এখন চাইলেই প্রতিবেশীদের সাথে একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, যদি এই সময়টাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে এ ভাইরাসটি সামাজিক দূরত্ব নয় সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ানোর সাহায্যকারী অনুসঙ্গ হতে পারে। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, সামাজিক যোগাযোগ হতে হবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা অনুযায়ী।
সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার অনেকাংশেই আমাদের কাছের মানুষদের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। আমরা এখন এই সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেই তাদের খবরা-খবর নিতে যোগাযোগ করতে পারি। সম্পর্ককে আবার গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারি।এটি আশার দিক যে, মানুষ এই সঙ্কটকালে একে অন্যকে সহায়তা করছে। পারস্পারিক সহযোগিতার এমন অনেক হৃদয়গ্রাহী উদাহারণ দেখা যাচ্ছে। ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগানো এবং অসহায়কে সাহায্য করার চেয়ে আত্মিক প্রশান্তিদায়ক আর কি হতে পারে?!
ইতিবাচক মানসিকতা এবং উন্নত আধ্যাত্মিকতা
মানুষের চরিত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সৃষ্টির শুরু থেকেই লক্ষণীয়। নবীরা (আ.) এবং পূণ্যবান ব্যক্তিরা যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যের ইতিবাচক দিকটি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু মানুষ তাদের নেতিবাচক কর্মগুলিকে নিবৃত্ত করে ফেলতে অপারগ। অধিক ক্ষমতা ,যশ-খ্যাতি , সম্পত্তি মানুষের চরিত্রকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক দিকে নিয়ে যায়। ক্ষমতা ও সম্পদের প্রতি অত্যাধিক লোভ মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। তখন তারা অহংকারে ফেটে পড়েন এবং মনে করেন তারাই দুনিয়ার শাসনকর্তা । তখন তারা পৃথিবীতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন । আল কোরআন তখন আমাদের মনে করিয়ে দেয়-
মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে; যাতে ওদের কোন কোন কর্মের শাস্তি ওদেরকে আস্বাদন করানো হয়। যাতে ওরা (সৎপথে) ফিরে আসে। [সূরা রুম :আয়াত ৪১]
ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্য করোনা ভাইরাসের মতো একটি মহামারী হল মানবতা বিপর্যয়ের একটি সংকেত যা তাদের মনে করিয়ে দেয় যে তারা “আদমের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান “[সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত ৭০] এবং এই পৃথিবীর সেবক। এটি পৃথিবীতে মানুষ যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে তার একটি প্রতিকর্ম। পৃথিবীর পরিবেশের মানুষ যে ক্ষতি করেছে এবং কিছু মানুষ গরীবের উপর যে অন্যায় অবিচার করেছে সেসব তো আর অনুত্তরিত থাকতে পারে না!
যেহেতু রহমতের রমজান মাস প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে তারপরও মহামারীর প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই মুসলিমদের উচিত এই লক ডাউনের সময়টিকে সৃজনশীল কাজে ব্যয় করা। তাদের এখন থেকেই উচিত একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলা । তারা এই অতিরিক্ত সময়টিকে আত্মঅনুধাবনের কাজে ব্যয় করতে পারেন : বেশি বেশি বই পড়ে ,চিন্তা-গবেষণা করে ও জনসেবামূলক কাজে। সদকা দেওয়ার ভালো সময় এরচেয়ে আর কখন হতে পারে?
মুসলিমরা এই অতিরিক্ত পাওয়া সময়কে উপহার হিসেবে ভেবে নিজেদের মানবতা,ধৈর্য, সহনশীলতা বাড়িয়ে জীবনটাকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করতে পারেন।যা কিনা আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে বন্ধু আত্মীয়স্বজন ও পরিজনদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করবে। (লেখক: ড. মুহাম্মদ আবদুল বারী ব্রিটিশ –বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ,প্যারেন্টিং কন্সালটেন্ট ও লেখক। তার এই লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছে হাসানাত ফারিহা নূন।)