হৃদয়ে আলো পৌঁছায় পরিশুদ্ধতায়; আর পরিশুদ্ধতার মূলে রয়েছে ঈমান-ইখলাছ ও তাওহিদ। আঁধারের ঘনঘটায় দ্বীনের আলো প্রভা বিচ্ছুরিত করে মস্তিষ্কের নার্ভ সিস্টেমে আসমানি বার্তা পৌঁছে দেয়। এরপর সময়ের সিঁড়ি আলোকিতদের ঠিকানা গড়ে দেয় সেই সবুজ উদ্যানে যার তলদেশে নহর প্রবাহিত। আধুনিকতার আড়ালে বর্তমান প্রজন্মকে ঘিরে ধরেছে নীলনকশা খচিত পিশাচের কারাগারে, এটি এমন এক কারাগার যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকির। তরুণদের জীবনের সোনালি একটি সময় নষ্ট হচ্ছে কয়েক মুহূর্তের বিনোদনের নামে অশ্লীলতার লাল-নীল ফ্যান্টাসির জগতে। বর্তমানে মিডিয়া বা গণমাধ্যম অশ্লীলতাকে সহজ করে উপস্থাপন করছে, অশ্লীল বিনোদনের ক্ষেত্র সবসময় থাকে আকর্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি; বর্তমান বিশ্বব্যাপী মিডিয়া বিয়েবহির্ভূত প্রেমকে খুব সহজভাবে তুলে ধরছে। অথচ সমাজের হাজারো সমস্যার সৃষ্টি হয় এসব অবৈধ সম্পর্ক থেকে। তাই ইসলাম এটিকে হারাম করেছে। ইসলাম হালাল করেছে বিয়ের মতো পবিত্র ও যৌক্তিক সম্পর্ককে। তাই অভিনব পদ্ধতিতে জঘন্যতম পথে তরুণদের আহ্বান করা বন্ধ করতে হবে। আবার কিছু কিছু জ্ঞানহীন ব্যক্তি অশ্লীলতাকে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম হয়ে কাজ করছে। হোক তা একটি লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বা শুধু ভিডিওটি দেখা; এসব কিছু নিখুঁতভাবে আরশে আজিম থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। সব কিছু দেখা হচ্ছে, সব কিছু লেখা হচ্ছে। অশ্লীলতার এই বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ এখনই দেখা যাচ্ছে তা নয়, জন দ্বিতীয় পোপ পল যখন ভ্যাটিকানের প্রধান যাজক ছিলেন তখনই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল ভ্যাটিকান থেকে। দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিল তখন বলেছিল, ‘এ বছরের উদ্বেগজনক অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে মিডিয়াতে পর্নোগ্রাফি ও বেপরোয়া সহিংসতার ব্যাপক বৃদ্ধি।’ এ সূত্রে বই, ম্যাগাজিন, রেকর্ডিং, সিনেমা, থিয়েটার, টেলিভিশন, ভিডিওক্যাসেট, বিজ্ঞাপন এমনকি টেলিকমিউনিকেশনগুলো প্রায়শ হিংসাত্মক আচরণ ও যৌন ক্রিয়াকলাপের সুযোগ দেয় যা প্রকাশ্যে পর্নোগ্রাফিক ও নৈতিকভাবে আপত্তিকর পর্যায়ে পৌঁছে।’ কাউন্সিল আরো উল্লেখ করেÑ ‘পাপ দ্বারা বিকৃত মানব প্রকৃতির অন্ধকার দিকের প্রতিফলন হিসাবে; পর্নোগ্রাফি ও সহিংসতার উচ্ছ্বাস মানব অবস্থার প্রাচীন বাস্তবতা।’ গত ত্রৈমাসিক শতাব্দীতে এটি নতুন মাত্রা গ্রহণ করেছে এবং গুরুতর সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠেছে। নৈতিক নিয়ম সম্পর্কে বিস্তৃত ও দুর্ভাগ্যজনক বিভ্রান্তির সময়ে যোগাযোগমাধ্যম পর্নোগ্রাফি ও সহিংসতাকে যুবক এমনকি শিশুসহ ব্যাপকভাবে দর্শকদের কাছে অ্যাক্সেসযোগ্য করে তুলেছে এবং এটি একটি সমস্যা, যা একসময় প্রধানত ধনী দেশগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল এখন শুরু হয়েছে যোগাযোগমাধ্যমের সুযোগ নিয়ে তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর নৈতিক মূল্যবোধকে কলুষিত করছে।’ ভ্যাটিকান কাউন্সিলের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, যোগাযোগমাধ্যম একতা ও বোঝাপড়ার কার্যকরী যন্ত্র হতে পারে, অথচ তা কখনো কখনো জীবনও পরিবার, ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতি বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির বাহন যা কোনোভাবেই প্রকৃত মর্যাদাকে সম্মান করে না। বিশেষ করে বিশ্বের অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবক তাদের সন্তানরা যে ফিল্ম, ভিডিওক্যাসেট ও টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলো দেখছে, শিশুরা যে রেকর্ডগুলো শুনছে এবং তাদের শিশুরা যেসব প্রকাশনা পড়ছে সে সম্পর্কে বোধগম্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা ঠিকই দেখতে চায় না যে বাড়িতে নৈতিক আদর্শকে আপত্তিকর সামগ্রী দ্বারা ক্ষুণœ করা হয়েছে, যা প্রায়ই যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক জায়গায় খুব সহজেই অ্যাক্সেসযোগ্য হচ্ছে।
আজ যে নৈতিক অবক্ষয় বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যমের পথ ধরে বিস্তৃত হচ্ছে তা এখন গোটা মানবজাতির সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৯ সালের ৭ মে ভ্যাটিকানের যে বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছিল এখন বাংলাদেশের অবস্থার সাথে তা মেলালে মনে হবে এটি এ সময়কে সামনে রেখে দেয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে সিরাজুম মুনিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে সময়ে আবির্ভাব তখনকার সামজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে একই ধরনের চিত্র আমাদের সামনে আসবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে এ সমস্যাটি একটি বিশেষ সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানবজাতির জন্য এটি একটি চিরন্তন সমস্যা।
এ জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু সতর্ক করে বলেছেন- ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।; (সূরা নূর-১৯) সূরা লুকমানের ৬নং আয়াতে রাব্বুল আলামিন বর্ণনা করেছেনÑ ‘তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আজাব।’ ব্যথাতুর কথা হচ্ছে- উম্মাহর জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ বিষয় আর কী হতে পারে? যাদের জন্য মহান আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন, তারাই বর্তমান মুসলিম প্রজন্মের আইডল। যাদেরকে রাব্বুল আলামিন তিরস্কার করছেন তাদের রঙঢঙ হয়ে গেছে তরুণ-তরুণীর একমাত্র ব্যস্ততা। হায় আফসোস তাদের জন্য, যারা দ্বীনহীন জীবনযাপন করতে করতেই কবরে পৌঁছে যায়। আল্লাহ তায়ালা সব রকম গোপন প্রেমে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। নিষিদ্ধ সব কাজে লাইক, কমেন্ট শেয়ার- হারামের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ; মূলত এসব এক্টিভিটি রবের বিরুদ্ধাচরণের মাপকাঠি। কেননা লাইক, কমেন্ট, ভিউ তাদেরকে অনুপ্রেরণা দেয়, তাদের এই নোংরা কর্মকে আরো প্রভাবশালী করে। এভাবেই একজন থেকে হাজারজনের কাছে অশ্লীলতার কার্যকলাপ পৌঁছে তরুণ প্রজন্মের হৃদয় রোগাক্রান্ত হচ্ছে এবং লজ্জা উঠে যাচ্ছে।
ফাহশাহ অর্থ লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা। আরবিতে কিছু শব্দ আছে যার অর্থ একই, যেমন- ফাহাশ ও ওয়াহাশ শব্দের অর্থ বন্যপ্রাণী (যে বন্যপ্রাণীর মতো আচরণ করে)। প্রকৃতপক্ষে লজ্জাহীনতা এমন একটি আচরণ যা বন্যপ্রাণীর আচরণের মতো। আমাদের এমন মানুষ হতে হবে যেন আমরা নিজেদের এবং অন্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। সার্বিক অশ্লীলতা ও আত্মিক সমস্যা যা আমাদের চোখ নিচে রাখতে দেয় না তা থেকে রাব্বুল আলামিন আমাদের হেফাজত করুন, অশ্লীলতার কিনারা থেকে আমাদের দূরে রাখুন; এ দোয়া বেশি বেশি করতে হবে। আল্লাহ বলেনÑ ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ করে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।’(সূরা মোনাফিকুন : ৯) এই আয়াতে যাদের ভালোবাসা জায়েজ ও ইবাদত, তাদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে- তারা যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। তা হলে যেসব সম্পর্ক মহান আল্লাহ হারাম করেছেন, তা কতটা জঘন্য হবে?
রাব্বুল আলামিন মুমিনদেরকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন-হে রাসূল! আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তায়ালা সে ব্যাপারে খবর রাখেন। (সূরা নূর-৩০) মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে অশ্লীলতার ধ্বংস থেকে হেফাজত করুন। এই অশ্লীলতার জন্য অনেক জাতিকে ধ্বংস করার বিবরণ পবিত্র কুরআনে রয়েছে। হারাম সম্পর্ক (যিনা-ব্যভিচার) সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সার্বিক অশ্লীলতা থেকে আমাদের হেফাজত করুন, আমাদের শুদ্ধ সুস্থ হৃদয় দিন। আমিন!